Friday, January 21, 2022

পায়ে পায়ে পুরানো কলকাতা

 পুরানো কলকাতার প্রতি আমার একটা অদ্ভুত নেশা আছে। যদিও আমি মনে করি এই নেশার জন্য অনেকাংশে দায়ী স্বনামধন্য লেখক শ্রীপান্থ। কি দরকার ছিল মশাই "কলকাতা" বইটা ওইরকম ভাবে লেখার?? একেবারে কলকাতার নেশা ধরিয়ে তবে ছাড়লেন!! কিছুদিন আগে স্কুলের অন্যতম প্রিয় বন্ধু অনির্বাণ (কর্মসূত্রে মুম্বইয়ে থাকে এখন) যখন বললো "কলকাতা এসেছি.... চল একদিন বেরোই" তখন একটা প্ল্যান করে ফেললাম যাতে ঘোরাও হবে আবার পুরোনো কলকাতাকে কাছ থেকে দেখাও হবে। দুই বাল্যবন্ধু মিলে প্ল্যান করলাম ২রা জানুয়ারি বেরোবো। সঙ্গে যোগ দিল আমার বেটার হাফ মিতা। ঠিক করলাম ভিড় এড়িয়ে ঘুরবো। আর পুরোনো কলকাতার খোঁজেই যখন বেরোলাম তখন দুপুরের পেট পুজো কোনও পাইস হোটেলে সেরে নেবো। তারপর পায়ে হেঁটে একটু এদিক সেদিক। 


প্ল্যান অনুযায়ী শুরু করলাম জানবাজারের "সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমে" পেট পুজো করে। কলকাতার এই পাইস হোটেলের জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম। তারপর থেকে প্রায় ১০০ বছরের কাছকাছি সময় ধরে সুনামের সঙ্গে খাবার পরিবেশন করছে এই হোটেল! অধুনা "বেঙ্গলি কুইজিন" হোটেল গুলোর মতো অ্যাম্বিয়েন্স এখানে পাবেন না। এই পাইস হোটেলে যেটা পাবেন সেটাই সবথেকে দরকারি..... সুস্বাদু খাবার! যাই হোক.... ভাত, ডাল, আলুভাজা, পোস্তর বড়া, সীম সর্ষে, দু রকমের মাছের ঝাল, মটন কষা আর চাটনি দিয়ে দুপুরের পেটপুজো সেরে ফেললাম। ভাবছেন এতো কিছু সাঁটিয়ে দিলাম কিভাবে? তা একটু পেটুক বটে আমরা 😁😁। অতঃপর? আরে বাবা বাঙালি তো.... এতকিছু খেলাম আর প্রাণটা এট্টু মিষ্টি পান মিষ্টি পান করবে না তা আবার হয় নাকি?? তাই আমিনিয়ার পাশে "তাজমহল পান শপ" থেকে মিষ্টি পান খেয়ে ফেললাম। দোকানদার মনিরুদ্দিন মিয়াঁ আবার মহম্মদ রফি সাহেবের একনিষ্ঠ ভক্ত! দোকান সাজানো রফি সাহেবের ছবি দিয়ে আর দোকানে বাজছে রফি সাহেবের গান! এহেন মানুষের দোকানের মিষ্টি পান খাসা বৈকি! অবশ্য পান খাবার আগে রানি রাসমণির বাড়ি দেখে নিয়েছি।


পেট পুজো পর্ব শেষে হাঁটা এগোলাম পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এখানে জরুরি কাজের জন্য মিতা আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করে ফিরে গেলো। তারপর এসপ্ল্যানেড মোড় থেকে বাস ধরে চললাম পরবর্তী গন্তব্য "মেটক্যাফ হল" এর দিকে। স্ট্র্যান্ড রোডের ওপর মিলেনিয়াম পার্কের ঠিক উল্টো দিকেই দেখতে পাবেন ১৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো বিল্ডিং মেটক্যাফ হল। ১৮৪০ থেকে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত এই বিল্ডিংটির নামকরণ তৎকালীন গভর্নর জেনারেল চার্লস মেটক্যাফের নামে করা হয়। অনেকেই জানেন না এটি বর্তমানে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ্ ইন্ডিয়া দ্বারা পরিচালিত একটি মিউজিয়াম এবং এর বিশেষত্ব হচ্ছে পুরো মিউজিয়ামটি কলকাতার ওপর! কলকাতার জন্মলগ্নের অয়েল পেন্টিং, ফোটোগ্রাফ, সংস্কৃতি, সিনেমা, উৎসব প্রভৃতি জিনিষ নিয়ে সাজানো অভিনব এক মিউজিয়াম! ঢুকতে টিকিট বাবদ ২৫ টাকা লাগে। ভেতরে ছবি তোলা যায়। আমার তো দারুণ লাগলো। উল্টোদিকের মিলেনিয়াম পার্কের হৈ হট্টগোলের সম্পূর্ন বিপরীত চিত্র পাবেন এখানে। গুটিকয় কলকাতা প্রেমী ছাড়া খুব একটা কারুর দেখা এখানে পাবেন না!


মেটক্যাফ হল দেখে কিরণ শঙ্কর রয় রোড ধরে এগিয়ে চললাম.... পরের গন্তব্য রাজ ভবনের উল্টোদিকে অবস্থিত "সেন্ট জনস্ চার্চ"। ১৭৮৪ থেকে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত এই গির্জা কলকাতার তৃতীয় সবথেকে প্রাচীন গির্জা। শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের দান করা জায়গায় তৈরী হয় এই গির্জা। তৎকালীন সময়ে একে "পাথুরে গির্জা" নামেও জানা যেত। ১৮৪৭ সাল নাগাদ সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল নির্মিত হলে এর গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়। চার্চ ছাড়াও এখানে আরও কয়েকটি আকর্ষণ আছে। তার মধ্যে একটি নিঃসন্দেহে জোব চর্ণকের সমাধী। এছাড়াও দেখতে পাবেন দ্বিতীয় রোহিলা যুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, "বেগম" জনসনের সমাধী, লেডি ক্যানিংয়ের সমাধী, কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্ট ইত্যাদি। চার্চ কম্পাউন্ডের ভিতরের পরিবেশ একেবারে শান্ত তাই জায়গাটিও ভালো লাগতে বাধ্য! এখানে প্রবেশমূল্য ১০ টাকা।


হলওয়েল মনুমেন্ট দেখার পর ইচ্ছে হলো একবার পুরোনো ফোর্ট উইলয়াম চত্বর থেকে ঘুরে আসি। তাই হাঁটা মারলাম বিবাদিবাগের দিকে। ভাবছেন হয়ত ফোর্ট উইলিয়াম তো সম্পূর্ন উল্টোদিকে তবে বিবাদিবাগের দিকে গেলাম কেন? আসলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৈরী প্রথম ফোর্ট উইলিয়াম এখানেই ছিল। ১৭৫৬ সালে সিরাজ-উদ-দৌলার ফৌজ যখন কলকাতা দখল করে তখন সেই যুদ্ধে পুরোনো ফোর্ট উইলিয়াম প্রায় ধুলোয় মিশে গেছিলো! সেবার সিরাজ কলকাতার নাম পাল্টে "আলিনগর" করে দিয়েছিল! আর সেই সময় এখানেই নাকি ঘটেছিল কলকাতার ইতিহাসের সেই বিতর্কিত অধ্যায় "ব্ল্যাক হোল ট্র্যাজেডি" বা "অন্ধকূপ হত্যা। হলওয়েল মনুমেন্ট সেই ঘটনার স্মৃতির উদ্দেশ্যেই তৈরী! পরে লর্ড ক্লাইভের তত্বাবধানে ১৭৫৮ সালে বর্তমান ফোর্ট উইলিয়াম তৈরীর কাজ শুরু হয়। শেষ হয় থেকে ১৭৮১ সালে। এখন সেই পুরোনো দুর্গের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দুটি হেরিটেজ বিল্ডিং.... একটি ফেয়ারলি প্লেস এবং অপরটি GPO! এতগুলো বছর পরে সেই পুরোনো দুর্গের চিহ্ণ খোঁজাটা অসম্ভব। তবে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের দিকে GPOর শেষ মাথায় একটি ফলক বসানো আছে! প্রথম ফোর্ট উইলিয়ামের সীমা নির্ধারণ করা আছে ফলকটিতে। নীচে সিঁড়িতে ব্রাস লাইন আছে যেটা দিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামের সীমানা বোঝানো হয়েছে.... যদিও এখন সেই ব্রাস লাইন অনেকটাই অস্পষ্ট। সত্যি বলতে হঠাৎ দেখলে কেউ এই জায়গার গুরুত্ব বুঝবে না.... তবে যারা আমার মত পুরোনো কলকাতার নেশায় পাগল.... তাদের কাছে এই জায়গা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ন!


পুরোনো ফোর্ট উইলিয়ামের অবশিষ্ট সীমানা দর্শন করে দুই বন্ধু মিলে গল্প করতে করতে বাড়ির পথ ধরলাম। মহানগর কলকাতার ব্যাপ্তির তুলনায় আমাদের এই ঘোরা নেহাতই নগন্য। তবে কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুরোনো কলকাতাকে কাছ থেকে দেখার নেশায় যে আবারও বেড়িয়ে পড়বো সেটা বলাই বাহুল্য!!



No comments:

Post a Comment