কথায় আছে, কালি–কলম–মন, লেখে তিনজন। আমি বলি, ইচ্ছে–সঙ্গী–রেস্ত, খাদ্য পাবেন বেশ তো! খাওয়ার ব্যাপারটা এমনই, যে আপনি চাইলেও এড়িয়ে থাকতে পারবেন না, এবং সমমনস্ক বন্ধুবান্ধব, সে ঠিকই জুটে যাবে! কল্লোলিনী তিলোত্তমা, সিটি অফ জয়, মিছিল নগরী, কলকাতার বহুরূপী ছাঁদ, ধরা ভারী মুশকিল। আমি আবার বৈদুর্য্য রহস্যের মদন বোসের মতোই শহরটার ডিসকমফোর্ট ছাড়া বেশিদিন থাকতে পারিনা।
তা হলো কি বুঝলেন, গতবছর, এই জানুয়ারি মাসের শেষেই একদিন কথা হচ্ছিলো বন্ধু দেবাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, আর শান্তনব রায় বাবুর সাথে, আমাদের বহুদিনের ইচ্ছে যে চীনে পাড়ায় ছোটা হাজরি, মানে ব্রেকফাস্ট, ওটি সারার। সে শুনেছিলাম সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে না গেলে অমিল, তাই আমরা গুটিগুটি পায়ে হাজির হয়েছিলাম, দিব্যি নানাবিধ চীনে সুখাদ্য, এক্কেবারে গরমাগরম, তারপর বাগবাজার ঘাটে, এবং দ্বিতীয়াংশ প্রসারিত হয়েছিলো উত্তর কলকাতার নামজাদা কিছু স্থানে, যথা চিত্তবাবু, সাবির, কফি হাউস, দেলখোসে কেবিন, প্যারামাউন্টে। সঙ্গী ছিলেন কৌশিকী গুপ্ত, অরিজিৎ সেন, জাভেদ ইসলাম, স্নেহাশীষ গাঙ্গুলিরা।
আমরা যখন চীনেপাড়ায় প্রাতরাশ সমাপনের দিকে এগোচ্ছি, তখন বন্ধ রেস্তোরাঁগুলির দিকে নজর পড়ায় জিগ্যেস করে জানা গিয়েছিলো সেগুলো খোলে সকালে এগারোটার পরে। তখনই একটা চটজলদি বৈঠকে স্থির করা গেছিলো, একবার আসতে হবে বৈকি, চীনে খাদ্যের মাধ্যমে রসনা তৃপ্তি তো অবশ্যই করা উচিত!
এর পরে আমরা গতবছর, অর্থাৎ ২০২১ সালে, এই অতি মারী, নৈরাশ্য, বাধাবিঘ্ন এসব পাশ কাটিয়ে এক এক করে চীনে ফুড ট্যুর, এবং আরেকটি বহু প্রতীক্ষিত পার্শী ফুড ট্যুর, যার সন্ধান দিয়েছিলো আমার আরেক বন্ধু সপ্তর্ষি দেববর্মন ,সেগুলো সমাপন করি। আমাদের সাথে আসে জয়ী চক্রবর্তী, অরিজিৎ ঘোষ, নিরূপম দেব, অন্বেষা চক্রবর্তী প্রমুখ খাদ্যরসিক মানুষজন। কি বলুন তো, সঙ্গী খুবই প্রয়োজন, মনের ভাব আদান-প্রদান এবং বিকাশের জন্য, এইটে আমার ভাবনা।
এছাড়াও আমরা টুকটাক দুয়েকটা খাদ্য অভিযান করেছি, নতুন, পুরনো, নামকরা, অখ্যাত সবকিছু না জানলে আর খেয়ে লাভ কি? সেরকমই, কিছুদিন আগে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে গেছিলাম "ওয়াহ্ জনাব", পার্ক সার্কাসে, ইচ্ছে ছিলো নিহারির, কিন্তু সেসময় সেটি না মেলায় খেয়েছিলাম কেবাব, কেবাবের প্ল্যাটার, নানারকম সুন্দর কেবাবের সমাহার, বীফ, এবং চিকেনের। বড়ো ভালো লেগেছিলো, এবং সেখান থেকেই আমাদের আগে থেকে স্থির করা মুঘলাই খাদ্য অভিযানের তালিকায় এটিকে স্থান দিই।
মুঘল রাজত্বের সময়কালে, বাবর থেকে বাহাদুর শাহ্ জাফরের সুদীর্ঘ সাম্রাজ্যর একটি প্রধান অংশ ছিলো তাদের খাদ্যাভ্যাস, একেকজন একয়েকরকম খাদ্যের অনুরাগী ছিলেন, কেউ বা পরীক্ষানিরীক্ষাতেও পিছপা হতেন না, কেউ ছিলেন সোজাসাপ্টা। তা, আকবর ভদ্রলোক এই আধুনিক মুঘলাই খানার কিছু অবিচ্ছেদ্য অংশের জন্য দায়ী বটে, সে মুর্গমসল্লম হোক, বা নবরত্ন কোর্মা (নবরত্নের প্রতি বেশ আকর্ষণ ছিলো, কি বলেন)? তেমনই আবার জাহাঙ্গীর সাজিয়েগুছিয়ে খেতে ভালোবাসতেন, মানে তাঁর খাদ্যগ্রহনের সময় অলঙ্করণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতো, যাকে বলে দস্তরখ্ব্যান বেশ সাজানো হতে হতো, আর স্ত্রী নূরজাহানের পটুত্ব ছিলো খাবারের সজ্জাতে, কখনো রামধনু রঙের দই, অথবা সুরা, সবেতেই একটা সৌন্দর্যের আবহ প্রকাশ করতেন বলে শুনেছি।
সে যাক, আমি মশাই ইতিহাসের ছাত্র নই, বেশিক্ষণ ধান ভানতে শিবের গীত গাইলে বিরক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই, এবার মাঠে নেমে পড়া যাক, আমড়াগাছি তো হলো! এবার আমাদের খাদ্য সফরের অন্যতম আকর্ষণ ছিলো আমার বাল্যবন্ধু রজত ব্যানার্জি, যে মাত্র তিনদিনের জন্য কলকাতায় এসেছিলো, এবং আমাদের এই প্ল্যানের কথা শুনেই সোৎসাহে রাজি হয়ে গেলো যোগ দিতে! এছাড়াও আমি, রায় বাবু, দেবাঞ্জন, জাভেদ ইসলাম, অরিজিৎ ঘোষ দা, জয়ী চক্রবর্তী দিদি, আর নতুন সদস্য সুদীপ্ত সাহা অভি দা, যারা সকলেই খাদ্যরসিক।
প্রথম যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো, তা হলো বিরিয়ানি আমাদের আজকের অভিযানে থাকছেনা। সকলেই কমবেশি সেটা খেয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় খেয়েছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খেয়েছে, বিভিন্ন মেজাজে খেয়েছে, তা-ই আজ নয়, আজ অন্যকিছু। তা-ই আমরা, মানে আমি আর রায় বাবু মিলে ঠিক করলাম কটি জায়গায় যাবো, এবং কি কি খাবো, সেটা বাকিদের জানানোর পরে কেউই আপত্তি করেনি, ভরসা কি একদিনে আসে মশাই? হুঁহুঁ!!
সকাল থেকে প্রস্তুতিপর্ব সেরে আমি, দেবাঞ্জন, রজত, আর জাভেদ পৌঁছে গেলাম পার্ক সার্কাসে, যেখানে উড়ালপুলের পাশেই অবস্থিত "ওয়াহ্ জনাব" রেস্তোরাঁ। স্বল্প সময় আগে রায় বাবু পৌঁছে গেছিলো, আস্তে আস্তে আমরা ঢুকলাম রেস্তোরাঁর অভ্যন্তরে, তখনও সেখানে গোছগাছ চলছে, আধঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে জানালেন কর্মচারীরা। বেশ কথা, নাহয় অপেক্ষা করবো, ভালো কিছু পেতে গেলে অপেক্ষা করাটাই দস্তুর, এতদিনে বুঝে গেছি! ঠাণ্ডা পানীয় অর্ডার করতে না করতেই এসে পড়লো জয়ী দি, আর সুদীপ্ত দা, অরিজিৎ দার সাথে কথা হলো খানিকক্ষণ পরেই আসছে, রাস্তাতেই আছে! প্রাথমিক আলাপ পরিচয় পর্ব মেটার পরে, কারণ রজতের সঙ্গে আমার আর দেবাঞ্জন ছাড়া কারোরই আলাপপরিচয় ছিলোনা, আমরা দিলাম এইবার খাবারের ব্যাপারে দৃষ্টিপাত, আলোকপাত করা যাক। সেই অনুযায়ী, আমরা বীফ প্ল্যাটার, এবং চিকেন প্ল্যাটারের অর্ডার দিলুম।
দুটি প্ল্যাটারেই নানাবিধ কেবাবের সমাহার। বিফ প্ল্যাটারে পেলাম কাকোরি কেবাব, মাখখনি কেবাব, বোটি কেবাব, এবং রেশমি কেবাব। প্রতিটি কেবাবের ঘ্রাণ নাসারন্ধ্র থেকে মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই মশলা দিয়ে জারিত সুসিদ্ধ মাংস, পুদিনার চাটনি, সালাড, এই সংমিশ্রণ বুঝলেন, খুবই লজ্জার ব্যাপার, মানে না খেলে লজ্জা পেতেই হবে!! চিকেনের প্ল্যাটারেও তেমনই টাঙড়ি কেবাব, সুলা কেবাব, রেশমি কেবাব, এবং লেহ্সুনি কেবাব। প্রত্যেকটির একে অপরের সাথে পার্থক্য, এবং মেলবন্ধন, দুটিই বোঝা যাচ্ছিলো। সুভদ্র মালিকের সঙ্গে আলাপ হলো, আমাদের আলোচনা শুনে তিনি নানান গল্প করলেন, কিভাবে সাত সাতবার জায়গাটির হাতবদল হয়েছে, এবং আমন্ত্রণ জানালেন তাঁদের বিফ মালাই একবার চেখে দেখতে! সেসব পাট চুকিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য ছিলো জমজম!
দাঁড়ান, দাঁড়ান, শুধু খাবার গপ্পো শুনবেন? আমি আছি, শুধু এসবই হবে, তা হয় নাকি? পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড় থেকে এগোবার সময়েই হঠাৎ দেখি ডানপায়ের জুতো দিয়ে দিয়েছে জবাব!!! সব্বোনাশ, কি হবে ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি, দেখি, বাঁ পায়ের জুতোর সোল বলছে, "আমি আসি, আমি আসি!" কি মুশকিল বলুন দিকি!! যা-ই হোক, বন্ধুরা খুঁজে পেলো আমীর আলী অ্যাভিনিউয়ের কোণের দোকানটি, দোকান, এবং মালিক, দুজনেই আমার সমকালীন, যাকগে! নয়া চটি পায়ে গলিয়ে, দুশমন পুরানো জোড়াকে বিসর্জিত করে এগোলাম পল্টন নিয়ে "জমজম"।
আগেই ভেবে রেখেছিলাম এখানে বিফ মালাই তো স্বাদ নেবোই, আর কি দেখা যাক! খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার ফাঁকে একপ্রস্ত চা পান, ধূমপান করে বসা গেলো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত রেস্তোরাঁয়। ভালো মানুষ ওয়েটার এসে নিয়ে গেলো অর্ডার, যথাক্রমে বিফ মালাই, চিকেন মালাই কেবাব, তন্দুরি রুটি, এবং মিষ্টান্ন রসিক রজতের প্রস্তাবিত শাহী টুকড়া, এবং ফিরনি। বিফ মালাই নিয়ে কথা বলাটাই কালক্ষেপ, খেয়ে দেখলে বোঝা যায়, অবশ্যই যাঁরা খান, অন্যদের জন্য চিকেন মালাই কেবাবও সুস্বাদু, নিরাশ হওয়ার প্রশ্নই নেই। তবে, আমি বাপু মিষ্টি খুব একটা ভালোবাসিনা, তাই ঐ ফিরনি, আর শাহী টুকড়া, মন টানলোনা। ইতিমধ্যে জাভেদের বান্ধবী, ইকরা রেহমান, আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলো। ভারী চমৎকার মেয়ে, প্রথম আলাপ মনেই হয়নি।
বেশ বেশ, এইসব সুখাদ্য গ্রহণের পরে স্বাদকোরক থেকে শুরু করে পাচনতন্ত্র, সবই তো মজে গেছে, তাই খানিকটা গপ্পোসপ্পো করে ইকরা বিদায় নিলো, আর ওরই পরামর্শে আমরা অটো পাকড়ে গেলুম ধর্মতলা! সেখানে আমাদের গন্তব্য ছিলো ইউ পি বিহার রেস্তোরাঁয়! নিউ মার্কেটে অবস্থিত এই খাদ্যস্থানটি অন্যগুলোর মতো সুসজ্জিত না বটে, কিন্তু আসল তো মশাই খাবার!! আহহা, বৃদ্ধ ওয়েটার এনে দিলেন যে মাটন কেবাব, ভেজা ফ্রাই, ক্ষীরি কেবাব, বিফ নিহারি, এবং তন্দুরি রুটি, প্রতিটি পদই এ বলে আমাকে দেখ, ও বলে আমাকে দেখ!! আড্ডা, গল্প, ছবি তোলা( এটি নাহলে তো উরিব্বাস!!) এসবের পালা সাঙ্গ করে আমরা যখন ক্ষান্ত দিলাম, সবাই-ই একমত, যে, আজ বিরিয়ানি বাদ রেখে, এবং পরবর্তীতে জাকারিয়া স্ট্রিট স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত একেবারে ঠিক! কারণ, জাকারিয়া স্ট্রিট শুধুমাত্র নিজের জন্যই একদিন দাবী করে।
ধর্মতলায় এসব খেয়েদেয়ে সবার মনে হতে লাগলো একটু মিষ্টিমুখ না করলে হয়? আমি মিষ্টি খুব একটা ভালোবাসিনা, কিন্তু কাছেই কে সি দাস, একবার ঢুঁ মারতে ক্ষতি নেই। তা, সেখানে যাওয়ার আগে রজত নিলো এবারকার মতো বিদায়, ব্যাঙ্গালোরে ফেরার প্রস্তুতিপর্ব কিছু বাকি আছে। আমরা ক'জন মিলে গেলুম, এবং গিয়ে নানারকম মিষ্টি দুয়েকটা করে বলা হলো! জয়ী দির সুপারিশে আমরা খেলুম কেশর পেস্তা মিষ্টি দই, এছাড়া কেউ রাজভোগ, কেউ জলভরা, কেউ আমভরা, কেউ কালোজাম, আমি আবার সাধ করে বললাম মালপো খাবো( যদিও পুরোটা খেতে পারিনি)।
এইসব সুন্দর জায়গায় সুন্দর মানুষদের সঙ্গে সুন্দর খাবার, দিন সুন্দর হবেই!! মধুরেণসমাপয়েৎ একেই তো বলে, তবে ফেরার পথে আমি, রায় বাবু, দেবাঞ্জন, আর জাভেদ এককাপ করে চা, আমাদের আরেকটা আড্ডার জায়গা, লেক মার্কেটের রাধুবাবুর দোকানে খেতে ভুলিনি।
আমাদের মূল উদ্দেশ্য স্রেফ খেয়ে বেড়ানো নয়, সে তো আমরা সবাই-ই কখনো না কখনো করিই, মূল নির্যাসমিশ্রিত থাকে এই আনন্দের অবকাশে, এই আড্ডা, হাসি, মজায়, ঐ যে, কেউ একজন বলে গেছেন,
"আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,