Friday, March 11, 2022

"বইমেলার কড়চা ১"

Kolkata Book Fair, Book Fair, Book Lovers, Creative Writing

"বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে, বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে....." বিশ্বকবির এই কবিতাটি জানেননা বোধকরি এমন কেউ নেই। ভ্রমণপিয়াসী মানুষের কাছে গন্তব্য, পথ, এবং পথের বাঁকের প্রতিটি দৃশ্য, নিসর্গ, বা মানুষের সাক্ষাৎ, সবই সুন্দর। নির্জনতা পছন্দ করেন যারা, তারাও এমন স্থানই সন্ধান করেন যেখানে বিজন বসে আপন মনের সাথে কথা বলা যায়। এসবের মধ্যে কোনো বাধাবিঘ্ন, ছোটখাটো অসুবিধা তাদের মোটেও থামিয়ে রাখতে পারেনা, পরেরবার নতুন কোনো জায়গায় যাওয়া। আবার এমন মানুষও আছেন, যারা কোনো না কোনো কারণে একাধিকবার একটি জায়গায় যেতে চান, আন্তরিক টানে, যা অন্যদের পক্ষে হয়তোবা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। 

আমি মশাই সেরকম নই, বেড়াতে যাইনি তা নয়, কিন্তু যেতেই হবে এমন কথা নেই, বরং না যেতে হলেও খুব একটা দুঃখিত হইনা। আমি এমন একজন অদ্ভুৎ প্রকৃতির মানুষ, যে একাধিকবার দিল্লী গিয়েও আগ্রায় তাজমহল দেখিনি বহুদিন, যখন দেখেছি সে ঠাঠা রোদ্দুরে পায়ের চেটো প্রায় সেঁকে যাওয়া দুপুরে। আবার, গোয়ায় ঘুরতে গিয়ে সমুদ্রে না যাওয়া মানুষও খুব সম্ভবত আমিই, যাকে বলে বিরল। কিন্তু, একটি ব্যাপারে আমি একপায়ে রাজী থাকি, তা হলো কলকাতার বইমেলা। ছোটবেলায় বাবামায়ের হাত ধরে, বয়স বাড়তে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, আবার কখনো বা একাই চট করে এক পাক ঘুরে আসা, এটি আমি সাধারণ, বা অসাধারণ কোনো কারণেই ফস্কে যেতে দিইনা৷ 

আমাদের ছোটবেলায় তো বইমেলা হতো ময়দানে, সবাই-ই মোটামুটি জানেন। যাতায়াতের সুবিধা থাকলেও সেখানে বেজায় ধুলো, আর একপ্রান্তে একেকটি স্টল, সে এক দিকদারি যাকে বলে, কিন্তু কি আর করা, সেভাবেই ঘুরতে হতো, দুইহাতে বইয়ের প্যাকেট, সাথে আসা বাবামায়ের হাতেও ধরা বইয়ের প্যাকেট, আর সবশেষে বেনফিশের গাড়িটা থেকে মনমাতানো খাবার( আমার আবার ফিশফ্রাই, কবিরাজির ওপর একটু পক্ষপাতিত্ব চিরকালই 😋)। ভাবতাম যে বইগুলো কিনবো, মেলায় ঢুকে আর হিসেব থাকতোনা, যা-ই দেখি, মনে হতো এটা নেবো, সেটা চাই!! মা-বাবা কখনো বইপত্র কেনায়, পড়ায় বাধা দেননি, বরং প্রচণ্ড উৎসাহ যুগিয়েছেন, এখনো তাই-ই, এ অত্যন্ত ভাগ্যের ব্যাপার। 

তারপর কালে কালে বইমেলার স্থান পরিবর্তন হতে হতে পার্ক সার্কাস, মিলনমেলা প্রাঙ্গণ হয়ে আজ বর্তমানে সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্ক। তা হোক, বছরের এই একটা সময় আমার কলকাতার সবকিছুই খুব ভালো লাগতে থাকে। বিভিন্ন দেশের থীম, আমাদের চেনা প্রকাশনার পাশাপাশি অনেক নামনাজানা সংস্থার সাজানো ডালি, পরিবেশনা... কতকিছুই যে জানা হলোনা, তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ আহরণের চেষ্টা। শুধুই তা নয়, লিটল ম্যাগাজিনের বিস্তার, অনামা শিল্পীর হাতের স্কেচ আঁকানো উৎসুক যুবক-যুবতী, নানান প্রান্ত থেকে আসা মানুষের ভিড়, কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা, এক লহমার মধ্যে নিজের শৈশবকালেই ফিরে যাওয়া.... সবই তো এই পরিবৃত্তে। 

অতিমারীর জন্য দুটো বছর বইমেলা আয়োজিত হয়নি, এ যে কি যন্ত্রণার, বলে বোঝানো কঠিন। তা-ই, যখন ঘোষণা শুনলাম, ২০২২ বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে ২৮শে ফেব্রুয়ারী থেকে ১৩ই মার্চ, মন ভরে উঠলো আনন্দে। আমার জন্য একটা ভালো বিষয় এইটি, যে বন্ধুবান্ধব, ঘনিষ্ঠের অনেকেই বইপ্রেমী, আমার চেয়ে বেশিই বই কম নন। তাই যেই না ব্যাপারটা শোনা, একটা প্ল্যান করে ফেলা গেলো যে, কবে যাওয়া হবে।

এইবারই প্রথম আমি বইমেলার উদ্বোধনের দিন গেলাম। এর আগে যতবারই গিয়েছি, ন্যুনতম দিন তিন-চার পরের থেকে। কিন্তু, ব্যতিক্রম এইবারই, কারণ এক বন্ধু পরদিনই শহর ছাড়ছে, কর্মব্যস্ত জীবনের যা স্বাভাবিক ব্যাপার। গিয়ে দেখলাম, কিছু কিছু স্টল তখনও গুছিয়ে উঠতে পারেনি, তোড়জোড় চলছে, কেউ বা বইয়ের সম্ভার গোছাতে ব্যস্ত, আবার কেউ ব্যানার ইত্যাদি লাগানোর কাজ করছেন। এরমধ্যেই মেলাপ্রাঙ্গণ পরিক্রমা করে মোটামুটি ধারণা করে ফেললাম যে, দিন কয়েক পরে যখন আসবো, কি কি বই অবশ্যই সংগ্রহ করবো, এবং গুরুত্বপূর্ণ স্টলগুলোর নং, অবস্থান ইত্যাদি। কিছু কিছু ক্যাটালগ সংগ্রহ করে ফেরার পালা, তবে "ঝিমিয়ে এলো বইয়ের ঘোর, কেনার পালা সাঙ্গ মোর" নয়, বরঞ্চ বলতে পারেন, এটা সবে শুরু বইমেলার কড়চার। 
Kolkata Book Fair, Book Fair Memories, Creative Writing, Book Lover


Tuesday, March 8, 2022

কিং বাছতে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!



ভোট। সে এক বড় বালাই বুঝলেন ! এবার বলবেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কর্মযজ্ঞ সে আবার "বালাই" কেন ? আরে মশাই সবসময় নেতা মন্ত্রী কর্মী সমর্থকদের দিক থেকে দেখলে হবে ? ভোটকর্মীদের দিক থেকেও দেখুন। তবে না বুঝবেন ! না না.. ওই "উফ্ফ... সে যে কি কষ্ট" মার্কা গল্প নয়। এই "সিরিয়াস" কর্মকাণ্ডের মাঝেও তো হাল্কা কিছু মুহূর্ত তৈরী হয়। সেগুলোই বলা যাক নাহয়।

সেবার ভোটের ডিউটি পড়েছে উত্তর কলকাতার একটি সেকেন্ডারি স্কুলে। সেকেন্ড পোলিং অফিসার বললেন "যাক বাবা... সেকেন্ডারি স্কুল... অতটাও খারাপ হবে না আশা করি"। জায়গায় পৌঁছে দেখা গেলো উনি যা ভেবেছেন ঠিক তার উল্টো। নামেই সেকেন্ডারি স্কুল। আসলে ভুতুড়ে বাড়ি! একে তো বাড়ির ওই দশা। তার মধ্যে সেদিন প্রচণ্ড গরম। এসবের মধ্যে আবার সিলিং ফ্যানের যা গতি তার চেয়ে কচ্ছপ জোরে দৌড়ায় ! রাতে শোওয়ার বারোটা বাজবে বিলক্ষণ বোঝা গেল। রিজার্ভ ফোর্সের এক জওয়ানের সঙ্গে আলাপ হল। সে বলল কেয়ারটেকারকে বলে ছাদে শোওয়ার একটা ব্যবস্থা করেছে। চাইলে শুতে যেতে পারি। সেকেন্ড পোলিং অফিসার বললো "হ্যাঁ হ্যাঁ.. ওপরেই একটু গড়িয়ে নেব রাতটুকু"। সেই মতো রাতের খাওয়া সেরে চাদর নিয়ে ছাদে চললাম। ছাদের সিঁড়িতে আবার লাইট নেই। অগত্যা মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট ভরসা। আগে সেই জওয়ান পিছনে আমি আর সেকেন্ড পোলিং অফিসার। আলো জ্বলতেই কানের কাছে শুরু হল ঝটপট শব্দ! দেখি রাজ্যের বাদুড়। আমাদের সাড়া পেয়ে প্রবল আপত্তিতে উড়ে বেড়াচ্ছে। কোনওমতে মাথা বাঁচিয়ে ছাদের দরজা খুলে চলে সেখানে গেলাম। সেকেন্ড পোলিং অফিসারের দিকে তাকাতেই দেঁতো হাসি হেসে বললেন "জানি কি বলবেন... তবে ভূত দেখেননি তো কি? কাছাকাছি একটা অভিজ্ঞতা তো হল"! 

তারপর ধরুন সব জায়গাতেই দাদা বা কাকা গোছের কেউ একজন থাকেন যিনি এলাকার প্রথম ভোটটা দেন। এই ব্যাপারে তাঁরা একদম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তো একবার মক পোল শেষ করে ভোট শুরু করতে ১০ মিনিট দেরী হয়ে গেছে। এদিকে নীচের লাইনে সেইরকমই এক কাকা চেঁচিয়ে পাড়া মাত করছেন। মিডিয়া ডাকবেন, ইলেকশন কমিশনের অফিসে ফোন করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন এজেন্ট বললো "চিন্তার কিছু নেই... ও পাঁড় মাতাল... ওইরকম একটু চেঁচায়... তবে ভোটটা সব্বার আগেই দেয়"। যথাসময়ে ভোটগ্রহণ শুরু হল। প্রথম ভোটার সেই মাতাল কাকু। দেখলাম বুথে ঢুকেও সেই একইভাবে চেঁচাচ্ছেন। যেন আমরা কি না অপরাধ করে ফেলেছি! প্রিসাইডিং অফিসারের অনুরোধেও থামার নাম নেই। হঠাৎ কোত্থেকে রিজার্ভ ফোর্সের কমান্ডিং অফিসার ঘরে ঢুকে পড়লেন। বাজখাঁই গলায় এক ধমকি মারলেন "ইয়ে ডান্ডা দেখতে হো... জাদা হল্লা করেগা তো এক ভি বাহার নেহি পড়েগা... একদম চুপ"! এতেই কাজ হল। এতক্ষনের অশান্ত কাকা একদম বাধ্য ছেলের মত ভোট দিলেন। তারপর বুথ থেকে বেরোনোর আগে প্রিসাইডিং অফিসারকে একটা প্রণাম ঠুকেই সোজা দৌড় !

আর একবারের ঘটনা। সেবার আমার প্রথমবারের জন্য প্রিসাইডিং অফিসারের ডিউটি পড়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই একটু চাপে আছি। যে স্কুলে ডিউটি পড়েছে সেখানে চারটে বুথ। তাই চারটে পোলিং টিম একই বাসে রওনা দিলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বাকি সব প্রিসাইডিং অফিসারদের ভোটের ডিউটির ভালোই অভিজ্ঞতা আছে। আমার প্রথম প্রিসাইডিং অফিসারের ডিউটি শুনে একজন বললেন "চিন্তার কি আছে... আমি তো আছি... ৬টা ইলেকশন করিয়েছি... কোনও অসুবিধা হলে সোজা চলে আসবে"। শুনে একটু নিশ্চিন্ত হলাম। অবশ্য কার্যক্ষেত্রে দেখলাম যা বলেছেন ঠিক তার উল্টো! যেকোনো ফর্ম ফিলাপ করতে গিয়ে উনি হয় আমাদের ঘরে আসছেন নয়তো পাশের ঘরে ছুটছেন! যাই হোক... ভোটের দিন সকালে দেখি বাকি দুজন প্রিসাইডিং অফিসার ওনাকে বলছেন "দাদা আর যাই করুন... সময়মতো ফর্মগুলো ভরতে থাকবেন... নাহলে শেষে খেই পাবেন না"। ভদ্রলোক নির্বিকার ভাবে বললেন "একদম চিন্তা করবেন না... দেখবেন সবার আগে ইভিএম সিল করে নেব"! যথাসময়ে ভোটগ্রহণ শেষ হলো। আমরা সব গোছগাছ করে রেডি। দেখি সেই "অভিজ্ঞ" ভদ্রলোকের কিছুই হয়নি প্রায়! ওনার টিমের লোকেরা আমাদের অনুরোধ করলেন "আপনারা একটু দেখুন... নাহলে আজ ইভিএম জমা করতে মাঝরাত হয়ে যাবে"! সবাই গেলাম। তিনি যথারীতি বললেন "চিন্তার কিছু নেই... এক্ষুনি হয়ে যাবে"। তো আরও একঘন্টা পেড়িয়ে গেলো কিন্তু "এক্ষুনি" আর হলো না। শেষে রিজার্ভ ফোর্সের কমান্ডিং অফিসার গিয়ে ধ্যাতানি মেরে বললেন "জো করনা হ্যায় RC (Recieving Centre) যাকে কিজিয়ে"। এতে কাজ হলো। ব্যাজার মুখ করে জিনিষপত্র নিয়ে বাসে উঠলেন অবশেষে। RC তে পৌঁছে কখন জমা দিয়েছিলেন সে অবশ্য আর জানা নেই। আমরা ওনাদের আগেই ইভিএম জমা করে বেড়িয়ে গেছিলাম!

আর একটা ঘটনা বলে শেষ করি। ভোট শেষ। ইভিএম নিয়ে RC তে যাচ্ছি। গাড়ির ড্রাইভার কলকাতার ছেলে নয় তাই খুব একটা রাস্তা চেনে না। আমরা তাড়া লাগাচ্ছি জলদি পৌঁছানোর জন্য। বেচারা এতকিছুর মধ্যে রাস্তা গুলিয়ে ফেলল। তো একটা সিগন্যালের মুখে সঠিক ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম। বলল যেদিক দিয়ে এসেছি সেদিকেই একটু পিছনের দিকে গেলেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবো। গাড়ি ঘুরিয়ে খেয়াল হল রাস্তা ওয়ান ওয়ে। ওদিকে উল্টোদিকে গাড়ি ঘুরছে দেখেই সার্জেন্ট এসে ধরলো। কিন্তু গাড়িতে ভোটের স্টিকার আর ইভিএম দেখে ছেড়ে দিল। সার্জেন্ট হেসে ড্রাইভারকে বললেন "নির্ভয়ে যা... তুই তো আজ ভিআইপি রে... কেউ তোকে ধরবে না!" সার্জেন্টের অভয়বাণী শুনে ড্রাইভারের হঠাৎ কি হল কে জানে... সেই ওয়ান ওয়ে রাস্তার উল্টোদিক  দিয়েই ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাতে লাগলো! ট্র্যাফিক পুলিশের অভয়বাণী পেয়েছে. তাকে আটকায় কে? হঠাৎ পেছনের সিট থেকে ফাস্ট পোলিং অফিসার চেঁচাতে লাগলো "ওরে ভাই... তোকে ভিআইপি বলেছে সেটা বুঝলাম কিন্তু একটু আস্তে চালা... এইভাবে গেলে তো ইভিএম RC তে পৌঁছানোর আগেই আমরা ওপরে পৌঁছে যাবো"!

এইরকম আরও কত ঘটনা থাকে। যাঁরা ভোটের ডিউটি করেছেন তাঁরা জানেন। হয়ত এই লেখার সঙ্গে রিলেট করতেও পারবেন। আসলে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল বদলে যায়, নেতা মন্ত্রী বদলে যায়.... কিন্তু ভোট রঙ্গ? সে তো চলতেই থাকে !