Monday, March 14, 2022

"বইমেলার কড়চা ২"



সবাই-ই জানেন, আমাদের কলকাতার বইমেলার স্থান পরিবর্তন হয়েছে বেশ কয়েকবার। ময়দান থেকে পার্ক সার্কাস হয়ে মিলনমেলা ছুঁয়ে আপাতত ঠাঁই হয়েছে যেখানে, নাম বইমেলা প্রাঙ্গণ, ভরসা করি এই-ই বুঝি শেষ, অন্তত আমার মতো অলসের জন্য এটাই যথেষ্ট, এরপর কি কলকাতার বাইরে কলকাতা বইমেলা যাবো, বলুন দিকি? তা সে তো হলো, প্রথম দিন সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে এইচি, এবার তো একটু আধটু নেড়েচেড়েও দেখা দরকার। তাই, স্থির করলাম বৃহস্পতিবার, মানে যেদিন কাজকর্ম থাকে একটু ফাঁক পাই, সেদিনই যাওয়া যাবে। যেমন ভাবা তেমনই কাজ, বন্ধুদের সাথে কথা বলে নিলাম, তারা তো সবাই আমার মতো খেয়ালখুশি মতো চলেনা, কাজকর্ম রয়েছে! সেইমতন আলোচনা করে দেখা গেলো দু-চারজন ঠিকই সঙ্গী জুটে যাবে( আরে বই পড়বেনা, এরকম আবার হয় নাকি? অবশ্য হয়, সে কথা অন্য কোথাও)।

মেলার সবই ঠিক আছে, তবে ঐ যে কইছিলাম, ভরদুপুরে শুরু, আর এইবার তারিখটাও পিছিয়েছে, বেরোলাম যখন, রোদ্দুর তখন বেশ ভালোই মালুম হচ্ছে! যথারীতি গেট পেরিয়ে ঢুকেই খোঁজ নিলাম কে কোথায় আছে? দুজন ইতিমধ্যেই পৌঁছে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিলো, আমিও যোগ দিলাম। এইবার দুয়েকটা ব্যাপার বেশ সুবিধাজনক মনে হয়েছে আমার, তার মধ্যে একটি হলো "বইমেলা ২০২২" মোবাইল অ্যাপ, যাতে বিভিন্ন স্টলের অবস্থান, নাম্বার ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া সহজ, নইলে সত্যি বলতে কি বারংবার একেকটা পছন্দসই, এবং প্রয়োজনীয় জায়গা খুঁজে বেড়ানো ঐ চত্বরে, চাট্টিখানি কথা নয়! আমি অবশ্য প্রাজ্ঞ সুকুমার রায়ের আপ্তবাক্য মেনে "এই দেখো পেনসিল, নোটবুক এ হাতে", মানে পকেটে নিয়ে গেসলাম, তাতে কোন বই কোথায় পাবো ইত্যাদি লেখা, সেইমতন শুরু হলো অভিযান.. কিন্তু, একবার দোকানে ঢুকলে, সারি সারি রংবেরঙের মলাটের বই সাজানো দেখলে, কোথায় খেয়াল থাকে? তখন মনে হয় "কী পাইনি, তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি"। হুম, প্রথম দিনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মণ্ডপে, মানে স্টলে এসে দুয়েকটি বই নেওয়ার কথা স্থির করেছিলাম, তাই সেখানে গেলাম। সেখানে অসাধারণ একটা সংগ্রহ দেখলাম "হারানো দিনের উজ্জ্বল গল্পমালা", যাতে সংকলিত আছে প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের রচিত নান স্বাদের ছোটগল্প। রয়েছেন সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, জলধর সেন, কার্তিক দাশগুপ্ত, সুবিনয় রায়, কুলদারঞ্জন রায়, পরিমল গোস্বামী, কে নন? এমন সংগ্রহের সুযোগ ছাড়ার প্রশ্নই আসেনা, তাই প্রথমেই সাতটি বইয়ের এই সেটটি নিলাম, মন ভালো হয়ে গেলো। সাথে নিলাম আশাপূর্ণা দেবীর গ্রন্থাবলীর দুটি খণ্ড, এমন লেখা যা-ই বলুন, আর হবেনা!!


এরপর আমরা একপ্রস্থ ঘোরাঘুরি করে বিভিন্ন বইপত্র দেখা শুরু করলাম, মূল উদ্দেশ্য একটা সম্যক ধারণা করে পরবর্তীতে কলেজ স্ট্রিট যাওয়া, এবং সেখান থেকে কেনাকাটা করা, যা-ই বলুন, মাঝেমধ্যে পকেটের কথাও চিন্তা করতে হয় বৈকি( এসব কথার কথা অবিশ্যি)... বর্তমানে যে প্রকাশনা সংস্থা গুলির বেশ নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানের আয়োজন দেখলাম। আমার বন্ধুদের থ্রিলারের দিকে বেশ ঝোঁক আছে, অনেকেরই লেখা পড়ে, এবং আমিও ওদের কাছ থেকে শুনে পড়েছি, যাদের মধ্যে কৌশিক মজুমদার, অভীক সরকার, প্রীতম বসু প্রমুখ বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছেন! তাদের অধুনা প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর দিকে নজর করলাম, দেখলাম আরও বেশ কিছু সংগ্রহ! এরপর সাহিত্য আকাদেমি স্টলে গিয়ে অন্যান্য ভাষার কীর্তিমানদের লেখা, কিংবদন্তী সাহিত্যিকদের রচিত বইগুলো দেখলাম, পছন্দ হলো শূদ্রক রচিত "মৃচ্ছকটিক" নাটকের বঙ্গানুবাদ যা সুকুমারী ভট্টাচার্যের করা, এবং ফণীশ্বর নাথ রেণুর হিন্দি রচনা সঞ্চয়ন। ওগুলো নেওয়া মনস্থির করে গেলাম একবার দে'জ পাবলিশার্স, সেখানে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট জনসমাগম হয়েছে, তা হোক, একটু ভিড় সয়ে নেওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। বাংলা সাহিত্যের মতো বৈচিত্র্য আর যে কোথায় আছে জানিনা, তা সেখানেও দেখা গেলো মতি নন্দী, দিব্যেন্দু পালিত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিমল কর প্রভৃতি কালজয়ী লেখকের বই, আর আমার যথারীতি অবস্থা দাঁড়ালো, যে পারলে পুরো মেলাটাই মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু আমি তো পবনপুত্র নই, আর বইমেলাও ইয়ে, গন্ধমাদন পর্বত নয়কো, তাই এ যাত্রা অজেয় রায়ের দুটি বই "অলৌকিক ও রোমাঞ্চ সমগ্র", এবং "রহস্য সমগ্র" কিনেই ক্ষান্ত দিলাম। ইনি আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক, যাঁর লেখা পূজাবার্ষিকীর পাতায় পড়ে বড়ো ভালো লাগতো। তাই, কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত লেখাগুলো দুই মলাটের মধ্যে পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত হলাম বলাই বাহুল্য! এরপর দু পেয়ালা চা না পেলেই নয়, এবং ততক্ষণে আরও দুই তিন বন্ধু যথাক্রমে সুদীপ্ত দা, সৌরভ বসু, এবং নিরূপম দেব আমাদের সাথে, অর্থাৎ সপ্তর্ষি দেববর্মণ, এবং সুরিত মুখার্জির সাথে যোগ দিয়েছে। 


চা পান, এবং ধূমপান করে আমরা শিশু সাহিত্য সংসদের স্টলে পা দিলাম। নামে যা-ই হোক, বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে কোনো কথা হবেনা মশাই, শিশু হোক, বৃদ্ধ হোক, মানে আবালবৃদ্ধবনিতা যা-ই হোক, পছন্দসই বই নেওয়ার জন্য সবই করা যায়, তাই না? তা সেখানে আমাদের আরেক প্রিয় লেখক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প সংগ্রহ নিলাম, শীর্ষেন্দু–সঞ্জীবের সঙ্গে অল্পবিস্তর আলোচনা করেই অবিশ্যি, মানে তাদের বই আপাতত রয়েছে কিনা, ইনি আমার বুকশেলফে শোভা বর্ধন করার জন্য আগমন করলে বড়োই বাধিত হবো!! তা সে যাক, এসব বইপত্র কিনে, বন্ধুদের সাথে তাদের সংগ্রহ নিয়ে আলোচনা করে যখন আকাশের দিকে চোখ পড়লো, দেখি সন্ধ্যা নামছে! চারদিকের উজ্জ্বল মুখগুলো আরেকটু ভালো লাগছিলো, ছোটদের হাতে নন্টে-ফন্টে, অথবা টিনটিন, ঠাকুরমার ঝুলি, কেউবা নিয়েছে প্রতিভা বসু, মহাশ্বেতা দেবী, কারোর প্যাকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে ঢোঁড়াই চরিত মানস, এমন সমাহারের জন্যই তো বারবার ছুটে আসা!! তখনই মনে পড়লো বহুকাল পূর্বের আরেকটি স্মৃতি, যখন তথাকথিত নিষিদ্ধ কল্পকাহিনীর আভাসের জন্য যেখানে ঢুঁ মারতাম, এখন যদিওবা সে পাট চুকেবুকে গেছে, আরেকবার ঝালিয়ে নিই না! তা-ই বেরিয়ে আসার আগে, যাওয়া গেলো মৌসুমী সাহিত্য স্টলে, সেখানে স্বনামধন্য পৃথ্বীরাজ সেনগুপ্তের "নীল ছবির নীল পরীরা" বইটি নিলাম, দোকানীর মুচকি হাসিটি চোখ এড়ায়নি। সব মিলিয়ে তখন শরীর বেশ ক্লান্ত হলেও মন চাঙ্গা, কারণ ঐ যে, এই একটি জায়গায় এসে সবকিছু ভুলে যেতে ইচ্ছে করে!!


বইমেলার আরেকটি সুব্যবস্থা আমার কাছে পর্যাপ্ত পানীয় জলের প্যাকেট, নইলে সত্যি মহা হয়, এতক্ষণ জলপান না করেও থাকা চলেনা, আর যত্রতত্র জলপান করাও যায়না, বোতল ফ্লাস্ক নিয়ে চলাফেরাও বিরক্তিকর, বিশেষত আমার মতো মানুষের পক্ষে, যার দুহাতে বই, এবং দশভুজা হওয়াও অসম্ভব! যা-ই হোক, সবকিছু মিলিয়ে আড্ডা, গল্প, এবং প্রিয় পরিবেশে ভ্রমণ, এই ছিলো আমার দ্বিতীয় দিনের বইমেলার সন্ধিক্ষণ। ফেরার পথে মনে হল এইবারের মত এই কি তবে শেষ? তারপরেই মনে হল হতেই পারে না! আরও একবার নাহলে ঠিক জমবে না! হ্যাঁ... তৃতীয়বার এসেছিলাম.... তবে সে গপ্পো পরের বার বলবো নাহয়।

যাঁরা বইমেলার কড়চা প্রথম পর্ব পড়েননি তাঁরা এখানে ক্লিক করলে পড়ে ফেলতে পারবেন প্রথম পর্বের অভিজ্ঞতা!