রোজকার জীবনের ব্যস্ত রুটিনের মধ্যে যখন হাঁফিয়ে উঠি তখন ইচ্ছে করে কোথাও একটু ঘুরে আসি। কিন্তু বড় ট্যুর করা তো সবসময় সম্ভব নয়। পকেটের ব্যাপারটাও তো দেখতে হবে। তাই কম খরচে একদিনেই ঘুরে আসা যায় এইরকম একটা ট্যুর প্ল্যান করে গত রবিবার, অর্থাৎ ২০ ফেব্রুয়ারি, বেড়িয়ে পড়লাম। পার্টনার হিসেবে বন্ধু শুভ্র। দু-একটা জায়গা দেখে রেখেছিলাম শনিবার দিন। সেসবের মধ্যে থেকে বেছে নিলাম পূর্ব মেদিনীপুরের মায়নাগড়। প্ল্যান অনুযায়ী সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পৌঁছে গেলাম প্রথম গন্তব্যস্থল এসপ্লানেড। সেখানে SBSTC বাস স্ট্যান্ড থেকে হলদিয়াগামি বাস ধরে নিমতৌড়ি। নিমতৌড়ি নেমে টোটো রিজার্ভ করে চললাম মূল গন্তব্য "ময়নাগড়" বা ময়না রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে।
ময়নাগড়ের প্রবেশ দ্বার |
টোটোতে প্রায় ২৫ মিনিট লাগলো ময়নাগড় পৌঁছাতে। জায়গাটার আসল নাম "ময়নাগড়" বা "কিল্লা ময়না চৌরা"। তবে স্থানীয়দের কাছে ময়না রাজবাড়ি নামটাই বেশি প্রচলিত। ওড়িয়া ভাষায় "চৌরা" শব্দটির অর্থ "জল বেষ্টিত উঁচু ভূমি"। আসলে প্রাচীনকালে তাম্রলিপ্ত বন্দরের প্রায় ১৬ কিমি পশ্চিমে কেলেঘাই, কংসাবতী এবং চান্ডিয়া নদী পরিবেষ্টিত এক দুর্ভেদ্য গড় ছিল ময়না চৌরা। প্রবেশ করার সময় প্রধান ফটকের গায়ে একটি লেখা চোখে পড়বে... "An Island Within An Island"। ময়নাগড়ের ভৌগলিক অবস্থান প্রমাণ করে গেটের লেখাটা কতটা সত্যি! বর্তমানে ২টি পরিখা ঘেরা দ্বীপটি সত্যিই An Island Within An Island!
একসময় "ধর্মমঙ্গল" কাব্যের নায়ক পাল বংশের রাজা লাউসেনের রাজধানী ছিল ময়নাগড়। পাল বংশের শাসনের পরবর্তী পর্যায়ে ময়নাগড় সম্ভবত পরিত্যক্ত ছিল। অনেক পরে এই জায়গা দখল করে শ্রীধর নামে এক জলদস্যু। সেসময় উৎকলরাজের আদেশে সবংয়ের রাজা গোবর্ধনানন্দ শ্রীধরকে পরাস্ত করে ময়নাগড়ের অধিপতি হন। খুশি হয়ে উৎকলরাজ গোবর্ধনানন্দকে "বাহুবলীন্দ্র" উপাধি দেন (বর্তমানেও ময়না রাজপরিবার এই উপাধি ব্যবহার করে থাকে)। আনুমানিক ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে বাহুবলীন্দ্র রাজবংশ নিজেদের রাজধানী "বালিসিতা" থেকে ময়নাগড়ে স্থানাতরিত করেন। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেসটিংস ময়নাগড় দখল করেন এবং তার সঙ্গেই শেষ হয় বাহুবলিন্দ্র রাজবংশের রাজ্যপাট। কথিত আছে শেষ স্বাধীন রাজা জগদানন্দ বাহুবলীন্দ্র নিজের বিশ্বস্ত অনুগামীদের সঙ্গে মাটির নীচে একটি গুপ্ত কক্ষে আত্মগোপন করেন এবং জীবদ্দশায় কোনোদিন আর বাইরে আসেননি। |
ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ |
রাজা গোবর্ধনানন্দ ময়নাগড় অধিগ্রহণ করে প্রথমেই সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার দিকে নজর দেন। তিনটি পরিখা (Moat) খনন করে মূল রাজবাড়িটি ঘিরে ফেলার ব্যবস্থা করেন তিনি। প্রতিটি পরিখার মধ্যবর্তী উঁচু জমিতে কামান বসানো থাকত। এছাড়াও ঘন কাঁটা বাঁশের ঝার দিয়েও ঘেরা থাকত দ্বীপের চারপাশ। বর্তমানে তৃতীয় পরিখাটির কোনও চিন্হ দেখতে পাওয়া যায়না। দ্বিতীয় পরিখা যার নাম "মাকরদহ", সেটিও রাস্তা তৈরীর স্বার্থে অর্ধেক বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে রয়ে গেছে "কালিদহ"। প্রায় ২০০ ফুট চওড়া এই পরিখা পেরিয়ে প্রবেশ করতে হয় ময়না রাজবাড়িতে। পেরোনোর একমাত্র মাধ্যম নৌকা।
গুগল আর্থে ময়নাগড়, কালিদহ এবং মাকরদহ |
এখানে ১২টা অব্দি নৌকা চলাচল করে। তার আগে গেলে নৌকা করে কালিদহের এক চক্কর ঘুরে আসতে পারবেন। আমাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে ১২:৩০টা হয়ে গেছিল। স্বাভাবিকভাবেই কোনও মাঝি ছিলেন না। তবে কলকাতা থেকে রাজবাড়ি দেখতে এসেছি শুনে এক সহৃদয় ভদ্রমহিলা নৌকা পার করে দিলেন। কালিদহ পেরোনোর সময় চারপাশের নারকেল গাছের সারী দেখে অনেকটা কেরলের ব্যাক ওয়াটারের মতো লাগবে। সেই অর্থে ময়নাগড়কে বাংলার "ব্যাক ওয়াটার" বলা যেতেই পারে!
কালিদহের পাড়ে নারকেল গাছের সারী, অনেকটা কেরলের ব্যাক ওয়াটারের মতোই |
ওপারে পৌঁছে চললাম রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। ঢোকার মুখে একটি ভগ্নপ্রায় তোরণ দেখা যায়। সংস্কারের অভাবে তার অবস্থা শোচনীয়। তারপরে ঘুরে দেখলাম রাধেশ্যাম জিউ মন্দির এবং সংলগ্ল নাটমন্দির। মন্দির বন্ধ হয়ে গেছিল তাই বিগ্রহ দর্শন সম্ভব হয়নি। তবে শুনলাম রাস উৎসব খুব ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হয় এখানে। মন্দিরের পাশেই রাজবাড়ি। দোতলার বারান্দায় একজনকে দেখতে পেয়ে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলাম। কলকাতা থেকে এসেছি এবং রাজবাড়ি দর্শনে আগ্রহী জেনে অনুমতি দিয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের নাম মনে নেই তবে পদবী দাস সেটা মনে আছে। তাই দাস বাবু বলেই সম্বোধন করবো। উনি সম্ভবত কেয়ারটেকার। এরপর উনি নিজেই বেশ দায়িত্ব সহকারে ঘুরিয়ে দেখলেন বাহুবলীন্দ্র রাজাদের বাড়ি। দোতলা এই রাজবাড়ির বর্তমান অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তবে বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে দেখলেই বোঝা যায়। রাজবংশের কেউ বর্তমানে এখানে থাকেন না।
নাটমন্দির |
রাধেশ্যাম জিউ মন্দিরে ভিতরে |
রাধেশ্যাম জিউ মন্দির |
দাস বাবুর সঙ্গে ঘুরে দেখলাম রাজবাড়ি এবং গল্পের মাধ্যমে রাজবংশের ইতিহাস শুনলাম। তিনি বললেন রাজবংশের স্ত্রীরা একবার রাজবাড়িতে প্রবেশ করলে আমৃত্যু এখানেই থেকে যেতেন। এমনকি অন্দরমহলের বাইরে যাওয়াতেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। রাজবাড়ির ভিতরে একটি গুপ্ত কক্ষ দেখলাম যেখানে বিভিন্ন জ্যামিতিক শেপের কুলুঙ্গি করা আছে। সম্ভবত এই ঘরটি জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার কাজে ব্যবহৃত হতো। এখানে একটি শান বাঁধানো তোরঙ্গ আছে যার ভিতরে নাকি লুকোনো আছে গুপ্তধন! তবে সেটা কেউ কোনওদিন কেনো খুলে দেখেনি সেটা ঠিক বোধগম্য হল না। এরপর রাজবাড়ির দোতলা, নাটমন্দির এবং প্রায় ২০০ বছরের পুরানো একটি কাঁঠাল গাছ দেখলাম। রাজবাড়ি দর্শন শেষে দেখলাম পেছনের জঙ্গলে পুরানো রাজবাড়ির ভগ্নাবশেষ। দাস বাবু বললেন ওই জঙ্গলেই নাকি এককালে অপরাধীদের শুলে চড়ানো হতো! সেসময় গড়ের নিরাপত্তার জন্য কালিদহের জলে ছাড়া থাকত কুমির!
রাজবাড়ির ভিতরে |
কুলুঙ্গি ঘর। এই বাঁধানো তোরঙ্গের ভিতরেই নাকি আছে গুপ্তধন! |
বিভিন্ন জ্যামিতিক শেপের কুলুঙ্গি |
পুরানো রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখে চললাম লোকেশ্বর শিব মন্দির দেখতে। আটচালার ধাঁচে তৈরী এই প্রাচীন মন্দিরটি। কথিত আছে মন্দিরের বিগ্রহ লাউসেনের আমলে প্রতিষ্ঠিত। যুদ্ধে যাওয়ার আগে উনি এখানে পুজো দিয়ে যেতেন। মন্দিরের গায়ে প্রাচীন টেরাকোটার কাজ চোখে পড়ে। মন্দির বন্ধ থাকায় বিগ্রহ দর্শন করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত গোটা দ্বীপে লাউসেনের সময়ের এই একটাই স্মৃতি চিন্হ অবশিষ্ট আছে। মন্দিরের উল্টোদিকে মনুমেন্ট আছে যেখানে জগদানন্দ বাহুবলীন্দ্রের সঙ্গে ওয়ারেন হেস্টিংসের যুদ্ধের কথা উল্লেখ আছে। এই দুটি মন্দির ছাড়াও এখানে একটি গাজী পীরের মাজার এবং একটি ধর্ম ঠাকুরের থান আছে। লোকেশ্বর শিবমন্দির দেখে এবং দাস বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা রওনা দিলাম খেয়াঘাটের দিকে। এবারও সেই সহৃদয় ভদ্রমহিলা (কোলে নিজের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে) অনায়াসেই আমাদের ওপারে পৌঁছে দিলেন।
লোকেশ্বর শিব মন্দির |
মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ |
মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ |
মন্দিরের গায়ের কারুকার্য |
প্রহরী |
ময়না রাজবাড়ির বর্তমান অবস্থা দেখে হয়তো খুব একটা আহামরি কিছু লাগবে না। তবে জায়গাটির সঙ্গে যুক্ত ইতিহাস জানলে সত্যি অবাক লাগবে! আসলে অনেক সময় অনেক সাধারণ জয়গাকেও তার সঙ্গে যুক্ত ইতিহাস বিশেষ করে তোলে। বলতে পারেন ময়নাগড়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেইরকমই! নৌকা পারাপারের সময় ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম "এইভাবে নৌকা চালাতে সমস্যা হয়না"? জবাবে তিনি বলেছিলেন "নৌকা চালাতে না জানলে পেটের ভাত জুটবে না"! মঙ্গলকাব্যের ঈশ্বরী পাটনির মতোই এই মহিলাও পেটের টানে নৌকা চালানো রপ্ত করে নিয়েছেন! সত্যি বলতে, ময়নাগড় না আসলে জানতেই পারতাম না কি অসাধারণ এক ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই দ্বীপের মধ্যে! কালিদহের অপর পাড়ে আমাদের টোটোওয়ালা দাদা অপেক্ষায় ছিলেন। আমরা যেতেই তিনি টোটো ঘুরিয়ে আবার নিমতৌড়ির দিকে রওনা দিলাম। আমাদের পিছনে, কালিদহের অপর পাড়ে পড়ে রইল বাংলার এক অজানা ইতিহাস!
নিমতৌড়ি ফেরার সময় ড্রাইভার দাদা বললেন টোটো স্ট্যান্ড থেকে মাত্র ৬ কিমি দূরে তমলুক রাজবাড়ি। চাইলে নিয়ে যেতে পারেন। হাতে সময় ছিল তাই বেশি না ভেবেই সেখানে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। তবে সে গল্প নাহয় পরেরবার শোনাবো।