বেনারস.... ভারতবর্ষ তথা গোটা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এক শহর। আনুমানিক ৫০০০ বছর বা তার চেয়েও পুরানো এই শহরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে কতো কাহিনী। কতো জানা অজানা ইতিহাস। আর সুপ্রাচীন এই নগরীর সঙ্গে বাঙালির যোগ কিন্তু বহু পুরোনো। পূণ্য ধাম কাশী বিশ্বনাথে পুজো দিতে যাননি এইরকম বাঙালির সংখ্যা বোধহয় হাতে গোনা। তাছাড়া বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন সময়ে বেনারস বা কাশীর বিশেষ উল্লেখ শহরটাকে আপামোর বাঙালি জাতির বড় কাছের করে তুলেছে। আজ তবে সেই ঐতিহাসিক শহরের গল্পই হোক... তবে একটু অন্যভাবে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে একদিন অফিস থেকে ফিরে চা খাচ্ছি। টিভিতে বেনারসের গঙ্গার ঘাটে সন্ধ্যাআরতির ওপর একটি তথ্যচিত্র দেখাচ্ছিল। সহধর্মিণী মিতা হঠাৎ বলে উঠল "আজ অব্দি বেনারস যাওয়া হয়নি... একবার ঘুরে আসলে মন্দ হয়না"। সেবার বিশেষ কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। মনটাও কোথাও যাওয়ার জন্য উসখুস করছিল কদিন ধরেই। তাই সাত পাঁচ না ভেবে যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করে ট্রেনের টিকিট কেটে রওনা দিলাম। সেবার বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দেওয়া, গঙ্গা আরতি দেখা, যন্তর মন্তর দেখা, রামনগর গিয়ে কাশীর রাজাদের প্রাসাদ দেখা, বিশ্বনাথ গলির রাবড়ি চেটে পুটে খাওয়া এবং বেনারসের বিখ্যাত পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা... এসব তো করেইছিলাম। এছাড়াও আরও কয়েকটি স্বল্পপরিচিত জায়গায় ঘুরেছিলাম। আজ বরঞ্চ সেবারে ঘুরে দেখা ৫টা স্বল্পপরিচিত জায়গার গল্পই শোনানো যাক। যাঁরা এইসব জায়গাগুলোর ব্যাপারে খুব একটা জানেন না তাঁদের কিছুটা পরিচিতি হয়ে যাবে। আর যাঁরা আগেই গিয়েছেন এইসব জায়গায় তাঁদের স্মৃতিচারণ হয়ে যাবে।
১. তিলভান্ডেশ্বর মন্দির - বাংলায় একটা প্রবাদ আছে "বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর"। প্রবাদটি এই স্থান বা বলা ভালো এই মন্দির সম্পর্কে খুব কার্যকরী। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই তিলভান্ডেশ্বর মন্দির। ১৮ শতকে নির্মিত এই মন্দিরের পূজিত দেবতা মহাদেব। মন্দিরের নির্মাণকাল ১৮ শতক হলেও পূজারীর কথা অনুযায়ী শিব লিঙ্গটি স্বয়ম্ভু লিঙ্গ এবং প্রায় ২৫০০ বছরের পুরোনো। অর্থাৎ মন্দির প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই লিঙ্গটি পূজিত হয়ে আসছে এখানে। তবে আসল রহস্য কিন্তু এই শিব লিঙ্গটিকে ঘিরে কাহিনী নিয়ে! কথিত আছে প্রতি বছর লিঙ্গটি নাকি আকারে এক তিল করে বৃদ্ধি পায়! কিভাবে এই ঘটনা ঘটে তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা অবশ্য নেই.... তবে প্রতিবছরই এই ঘটনা অবশ্যই ঘটে। গল্পটি বিশ্বাস অবিশ্বাসের যার যার নিজের ওপর। তবে কোন পান্ডা না থাকায় বেশ শান্তিতে পুজো দিতে পেরেছিলাম এখানে।
তিলভান্ডেশ্বর মহাদেব বিগ্রহ |
২. সংকটমোচন মন্দির - নামেই বোঝা যাচ্ছে মন্দিরের আরাধ্য দেবতা হনুমান। বিশ্বনাথ মন্দিরের সামনে থেকে অটো ধরে পৌঁছে গেছিলাম সংকট মোচন মন্দিরে। হনুমানের একটি বিশাল বিগ্রহ আছে এখানে এবং ভক্তদের ভীড় লেগেই থাকে সবসময়। পুজো দিতে গেলে একটু সাবধান থাকতে হবে কারণ প্রচুর বাঁদর চারপাশে ঘুরে বেড়ায় সর্বক্ষণ! কথিত আছে মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং তুলসিদাস! এখানেই তিনি হনুমানের দর্শন লাভ করেন এবং তাঁর বিখ্যাত কাব্য ' রামচরিত মানস ' রচনা করেন।
সংকটমোচন মন্দিরের বিগ্রহ |
৩. কেদারেশ্বর মন্দির - প্রাচীন এই মন্দিরটি বেনারসের কেদার ঘাটে অবস্থিত। মন্দিরের শিব লিঙ্গটি কেদারনাথ মন্দিরের লিঙ্গের আদলেই তৈরী। যদিও কারও কারও মতে এই লিঙ্গটিও স্বয়ম্ভু লিঙ্গ। মন্দিরটি এখানকার অন্যতম জনপ্রিয় মন্দির। ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র মনে হয়েছিল সময় যেন এখানে কোনও জাদুবলে থমকে দাঁড়িয়ে আছে!
কেদার ঘাটে কেদারেশ্বর মন্দির |
৪. হরিশচন্দ্র ঘাট - বেনারস এসেছে অথচ মনিকর্ণিকা ঘাটের নাম শোনেননি এইরকম লোকের সংখ্যা হয়ত খুবই কম। কিন্তু হরিশচন্দ্র ঘাটের নাম খুব বেশি লোক বোধহয় জানেন না! অথচ স্থানীয় মতে বেনারসের অন্যতম প্রাচীন ঘাট গুলির মধ্যে একটি এই হরিশচন্দ্র ঘাট। মনিকর্ণিকার মতোই এখানেও শবদাহ করা হয়। মনে করা হয় পুরাণের বিখ্যাত রাজা হরিশচন্দ্র রাজত্ব পরিবার সব ত্যাগ করে এখানেই শবদাহের কাজ করতেন!
৫. সারনাথ - বেনারস থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত সারনাথ। এক সময়ের জগৎ বিখ্যাত বৌদ্ধ মঠ ছিল এই সারনাথ। বলা হয় এখান থেকেই প্রথম ভগবান বুদ্ধ ধর্ম শিক্ষা প্রদান করেন! এছাড়া বৌদ্ধ 'সংঘের' শুরুও এই সারনাথ থেকেই! আমাদের জাতীয় প্রতিক অশোক স্তম্ভ প্রথমে এখানেই রাখা ছিল। পড়ে সেটি দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনও এখানে অশোক স্তম্ভের নীচের অংশটি স্বযত্নে রাখা আছে। বর্তমানে এই জায়গাটির রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব অর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ্ ইন্ডিয়ার হাতে। এখানে গেলে অবশ্যই পাশের মিউজিয়ামটি ঘুরে আসবেন। বহু অমুল্য প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন রাখা আছে এই মিউজিয়ামের মধ্যে।
![]() |
পালি ভাষায় খোদাই করা বাণী |
সেবার হাতে সময় বেশি ছিল না। মাত্র ২ দিন ছিলাম বেনারসে। তবুও যতটা সম্ভব ঘুরেছিলাম। খুব ইচ্ছে ছিল বেনারসের বিখ্যাত গলি গুলো ঘুরে ঘুরে দেখব! এমনকি "জয় বাবা ফেলুনাথ" উপন্যাসের মগনলাল মেঘরাজের ডেরা সেই "কচৌড়ি গলির" সন্ধানেও যাবো। সময়ের অভাবে সেই গলি আর খোঁজা হয়ে ওঠেনি! আসলে এত অল্প সময়ের মধ্যে এইরকম ঐতিহাসিক একটা শহর পুরো ঘোরা হয়ে ওঠে না। তাই আবারও ফিরে যাব বেনারসে। অদেখা জায়গাগুলো ঘুরে দেখব। জানবো অনেক অজানা কাহিনী... অনুভব করবো ইতিহাস... সঞ্চয় করবো অনেক নতুন অভিজ্ঞতা!
ও হ্যাঁ.... সেবার বেনারস পর্ব শেষ করে পাড়ি দিয়েছিলাম নবাবদের শহর লখনৌ এর উদ্দেশ্যে। সেই গল্প নাহয় পরের বারের জন্য তোলা রইল।
Dhasu
ReplyDeleteKhub bhalo laglo...
ReplyDeleteonek samridhdho holam.
বেনারসের সাথে একটা যোগ শুরু থেকেই হয়ে গেছে, কিছুটা অপু, কিছুটা আবার ফেলু–মগনলাল–মছলিবাবার দৌলতে, এই লেখাটায় কিছু অচেনা ঝলক পেলাম, ভালো লাগলো।
ReplyDeleteKhub valolaglo….chotobela r smriti gulo monepore gelo..ekta somoi every year jetam
ReplyDeleteঅসাধারণ লেখনী। বেনারস এখনও যাওয়া হয়নি।
ReplyDeleteতথ্যসমৃদ্ধ এই লেখা আমার বেনারস ভ্রমণ এ কাজে লাগবে। 🙏🏼🙏🏼
খুব সুন্দর। In-depth narration👍🏼
ReplyDelete