Friday, January 21, 2022

রহস্যময় ঊনোকোটি

করোনার জ্বালায় আপামোর ভ্রমণপ্রিয় বাঙালির প্রাণ ওষ্ঠাগত! কেউ কেউ সাহস করে বেড়িয়ে পড়লেও অনেকেই কিন্তু এখনও সেই সাহস জোগাড় করে উঠতে পারেননি। আমার কথাই ধরুন না.... সেই কবে থেকে চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় রয়েছি কবে বেড়াতে যাবো.... কিন্তু করোনা যেনো যেতেই চায় না.... অগত্যা স্মৃতিচারণ ভরসা।

আজ বলবো ঊনকোটির গল্প। ইন্টারনেটের দৌলতে অনেকেই ঊনকোটির নাম শুনে ফেলেছেন। অনেকেই ঘুরেও এসেছেন হয়তো। তা এই পোস্টের মাধ্যমে যাঁরা ঘুরে এসেছেন তাঁদের স্মৃতিচারণ হয়ে যাবে আর যাঁরা গিয়ে উঠতে পারেননি তাঁদের মানসভ্রমন হয়ে যাবে। উত্তর পূর্ব ভারতের ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরা। রাজধানী শহর আগরতলা থেকে প্রায় ২০০ কিমি দূরে অবস্থিত পাহাড় জঙ্গলে আবৃত রহস্যময় স্থান ঊনকোটি। যাঁরা ঐতিহাসিক এবং রহস্যময় জায়গা পছন্দ করেন তাঁদের জন্য যাকে বলে "ড্রিম ডেস্টিনেশন" একদম! 

"ঊনকোটি" কথাটির অর্থ এক কোটির চেয়ে এক কম.... অর্থাৎ ৯৯,৯৯,৯৯৯! বিভিন্ন প্রচলিত মতবাদ এবং কাহিনী অনুসারে ৯৯,৯৯,৯৯৯ দেব দেবীর স্থান এই ঊনকোটি! ত্রিপুরার উত্তর ভাগে কইলাশহর সাবডিভিশনের অন্তর্গত রঘুনন্দন পাহাড়ে অবস্থিত রহস্যময় ঊনকোটি। স্থানীয় "কক বড়ক" ভাষায় ঊনকোটির আরেক নাম "সুবরাই খুং"। এখানে গোটা পাহাড় জুড়ে খোদাই করা আছে বিভিন্ন দেব দেবীর আবক্ষ মূর্তি বা "বাস রিলিফ" (Bas relief)। আনুমানিক সপ্তম থেকে নবম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয় ঊনকোটির স্থাপত্যগুলি। কারও কারও মতে এগুলি আরও পুরোনো।

স্থানীয় লোক কথা মানলে ঊনকোটির ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পুরাণের নিবিড় যোগ আছে। ঊনকোটি নিয়ে একাধিক কাহিনী প্রচলিত আছে। তার মধ্যে থেকে সর্বাধিক জনপ্রিয় দুটি কাহিনী ছোট্ট করে বলেই ফেলি। কথিত আছে যে একবার ভগবান শিবের সঙ্গে ৯৯,৯৯,৯৯৯ দেবতারা কৈলাশ যাত্রা করছিলেন (কারও মতে জায়গাটি কাশি)। যাত্রা পথে প্রচণ্ড ক্লান্ত দেবতারা শিবকে অনুরোধ করেন বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। শিব রাজি হয়ে যান কিন্তু শর্ত দেন যে সকাল হওয়া মাত্রই যাত্রা আরম্ভ করতে হবে। সেই মতো সব দেবতারা ঘুমিয়ে পড়েন। সকাল হতেই শিব সবার আগে উঠে পড়েন এবং দেখেন বাকিরা তখনও ঘুমিয়ে। ব্যাস... রাগে তিনি বাকিদের অভিশাপ দেন যে এই জায়গাতেই সবাই পাথর হয়ে থেকে যাবেন! সৃষ্টি হয় ঊনকোটির।

আরেকটি কাহিনী অনুযায়ী এই জায়গায় বাস করতেন কালু নামে এক কুমার। অসাধারণ মূর্তি বানাতেন তিনি। সেই সঙ্গে একনিষ্ট শিব ভক্ত ছিলেন কালু। একবার শিব এবং পার্বতী কৈলাশ যাওয়ার পথে এই জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সেই সময় কালু কুমোর শিবকে অনুরোধ করেন তাঁকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে। শিব রাজি হন কিন্তু শর্ত দেন ভোর হওয়ার আগেই এক কোটি দেবদেবীর মূর্তি তৈরী করতে হবে কালুকে। সারা রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেও ঊনকোটি মূর্তি তৈরি করতে সক্ষম হন কালু। শর্ত অনুযায়ী শিবের সঙ্গে যাওয়া হয়ে ওঠেনা কালুর। সৃষ্টি হয় ঊনকোটির!

গল্পগুলি থেকেই আভাস পাওয়া যায় জায়গাটি মূলত শৈব তীর্থ। শিব ছাড়াও এখানে দেখতে পাবেন দুর্গা, বিষ্ণু, নন্দি, হনুমান প্রভৃতি দেবদেবীর মূর্তি। প্রায় ৩০ ফুট লম্বা "ঊনকোটিস্বর কলভৈরব" মূর্তিটি নিঃসন্দেহে এখনকার মূল আকর্ষণ! ছোট ছোট টিলা পাহাড় এবং জঙ্গলে ঘেরা প্রাচীন এই স্থাপত্যশৈলীগুলি আপনাকে অবাক করতে বাধ্য! স্থানীয়দের মতে আশেপাশের পাহাড়গুলোতে আরও অনেক মূর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যার অধিকাংশই অনাবিষ্কৃত। বর্তমানে জায়গাটির রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব A.S.I এর। সম্প্রতি UNESCO জায়গাটিকে World Heritage Site এর স্বীকৃতি দিয়েছে! 

আমি ঊনকোটি গিয়েছিলাম ২০১৪ সালে। সেই সময়ের তুলনায় এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। আগরতলা থেকে ট্রেন, বাস এবং প্রাইভেট গাড়িতেও পৌঁছে যেতে পারবেন ঊনকোটি। যাঁরা রাতে থাকবার প্ল্যান করে যাবেন তাঁরা কৈলাশহর চলে যেতে পারেন। এখানে থাকবার হোটেল আছে। সবমিলিয়ে অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা ঊনকোটি ভ্রমণ! না গেলে জানতেই পারতাম না পাহাড় জঙ্গলের মাঝে কত রহস্য নিয়ে অবস্থান করছে ঊনকোটি! যাঁরা এখনও যাননি তাঁরা এই করোনার ঝামেলা মিটলে ঘুরেই আসুন ঊনকোটি থেকে। যাঁরা ইতিমধ্যেই ঘুরে এসেছেন কমেন্ট বক্সে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন।

সবাই সুস্থ থাকুন.... ভালো থাকুন! 🙏

No comments:

Post a Comment