Sunday, April 14, 2024

দার্জিলিংয়ের দুয়েক কথা(প্রথম পর্ব)



"চল্, পাহাড়ে যাবি? দুচোখ বিস্ফারিত করে শুনলো বালক..."। না, এমন কোনো চিত্রনাট্য আমার ছোটবেলায় ঘটেনি, ঘটার সম্ভাবনাও ছিলোনা। পাহাড়–সমুদ্র–জঙ্গল বা প্রাকৃতিক যে কোনো আবহের প্রতি আকর্ষিত হওয়ার মতো অন্তর্নিহিত বোধ আমার খুবই সীমিত। বন্ধুবান্ধব, পরিজন ও প্রতিবেশীদের কাছে নানাবিধ সৌন্দর্যের কথা শুনেছি, জেনেছি, সবই ভালো। তা, এসব বলে তো আর সমাজে চলা যায়না। তাই, বিবাহের দিনক্ষণ মিটতে না মিটতেই লোকজন বলতে লাগলো কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা। বিশেষত দিদি আর বিপ্লব দা তো বলেই বসলো যে ওরে বাবা তুই তো খেতেটেতে ভালোবাসিস, তুই একবার দার্জিলিংয়েই ঘুরে এসে আমাদের উদ্ধার কর্! 

 একটু নেড়েচেড়ে, পড়েটড়ে, খোঁজখবর নিয়ে দেখলুম যে শহরটির খাদ্যসম্ভার বেশ ভালো এবং বৈচিত্র্য আছে। নিসর্গের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া যায় বৈকি, সেটা নেহাৎ মন্দ নয়, কিন্তু রসনার তৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে হিমেল হাওয়ার পরশ পেলে সেটাও বেশ ভালোই লাগে কিনা? যাক্, স্থির হওয়ার পরে টিকিট কাটা গেলো পদাতিক এক্সপ্রেসে, সে-ও একেবারে ফাস্টোকেলাস ক্যুপ! অতঃপর, দিন কয়েকের জন্য পানসি... থুড়ি পা চালাও পাহাড়ের গায়ে! 

 রাত্তির ১১.২০তে পদাতিক এক্সপ্রেসের ক্যুপে ওঠার পরে মালুম হলো বাহ্!! এ তো বেড়ে জিনিস, দরজাটা বন্ধ করলেই নিজেদের মতো হয়ে যায়। একটি রাতের মামলা বেশ শান্তিতেই কাটবে। কোনো সহযাত্রীর বায়নাক্কা নেই, উটকো মানুষের চেঁচামেচি নেই, মোবাইলে তারস্বরে গপ্পো বা সীট নিয়ে তক্কো কিস্যু নেই! সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামার পরে গাড়ির জন্য সামান্য অপেক্ষা। পরিচয় হলো ড্রাইভার দাদা নারায়ণের সঙ্গে, গল্প করতে করতে যাত্রাশুরুর ক্ষণ বয়ে চললো। এখানে বলা দরকার একজন ছোকরার কথা। তার নাম সুজিত চন্দ। শিলিগুড়ির ছেলে, আমাদের পরিচিত হয়েছে এ-ই সামাজিক মাধ্যমের একটি মঞ্চে যার সংক্ষিপ্ত নাম CBG.. কিন্তু দীর্ঘ দশ বছর পরে এ-ই পরিচয় সাক্ষাৎে পরিণত হলো এই সফরে। ওকে আমাদের বেড়াতে যাওয়ার কথা জানানোর পরে একটিবারের জন্যও চিন্তা করতে হয়নি গাড়ির জন্য কিম্বা যাত্রাপথের খাবারের জন্য, এতো দায়িত্বশীল এবং সদাহাস্য। জবা, অর্থাৎ সুজিতের সহধর্মিণী, সে-ও তেমনই, মানে ওরা একে অপরের পরিপূরক। 

 পথে একবার চা-সিগ্রেট নিয়ে দার্জিলিং পৌঁছালাম দুপুর দেড়টা নাগাদ। দুপাশে দূর থেকে চা-বাগান এবং পাইন গাছ ইত্যাদি দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো বলাই বাহুল্য। এরপর এলো পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা। না, হৃদয়ে শিহরণ জাগেনি, কিন্তু রোমাঞ্চকর তো বটেই খানিকটা। মাঝে কার্শিয়াঙে একবার গাড়ি দাঁড়ালো, দুয়েকটা ছবি তুলে নিলুম স্মৃতির জন্য। সস্ত্রীক প্রথমবারের জন্য কোথাও এসেছি, পরে কাজে লাগতেই পারে। 

 আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল অ্যালিস ভিলায়। দার্জিলিংয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ ম্যাল পেরিয়েই এ-ই বিলিতি ধাঁচের হোটেলটি। ম্যানেজার সদা হাস্যমুখ ধীরেন প্রধানের অনুপস্থিতিতে আমাদের স্বাগত জানালেন দীপেন বাবু(অচিরেই উনি দীপেন দা হয়ে উঠবেন)। ঘরটি দেখে মন ভালো হয়ে গেলো। তেতলার একটি প্রান্তে, নিরিবিলি ছিমছাম ঘর, সংলগ্ন বারান্দা। হ্যাঁ, আমার বাপু ঘরের বিছানা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন করার বাসনা না থাকায় সেরকম বসবাসের জন্য স্থান সন্ধান করিনি। 

 তা ঘরে ঢুকে স্নান সেরে বেরোলাম দুপুরের খাবার খেতে। ঠিক করে রেখেছিলাম প্রথম দিন হয় কেভেন্টার্স যাবো, নয়তো মোহন'স। তা সেদিন ছিলো বিষ্যুদবার, অতএব কেভেন্টার্স বন্ধ থাকায় পাশের রাস্তাতেই ছোট্ট ছিমছাম মোহন'সেই ঢুঁ মারলাম। এখানে মূলতঃ নেপালী খাদ্যের সন্ধান করা লোকজন আসেন এবং আমরা সেটাই করতে গেছিলাম। আমি বললুম নেপালী পর্ক থালি এবং আমার স্ত্রী, যিনি আমিষাশী হলেও দুরকম মাংসেই সীমাবদ্ধ আছেন তিনি চিকেন থালিই বললেন। থালিতে সাদা ভাতের সঙ্গে হরিদ্রাভ ভাতের দর্শন হলো ; ভদ্রলোক নিজেই জানালেন ওটি মকাইয়ের চালের ভাত। সাথে সাথে ছিলো নেপালী একটি শাকভাজা, মকাইয়ের স্যুপ( ডালের পরিবর্তে আরকি, তবে পাতলা ও স্বচ্ছ), ছোট ও গোল আলু যা কিনা মেটে আলুভাজা জাতীয়, পাঁপড়, স্যালাড ও কচ্ছুম্বর স্যালাড,  আচারএবং মধ্যমণি পর্কের ঝোল। অন্যান্য পদগুলো কিছুটা আলাদা বা অনভ্যস্ত বলে যে স্বাদহীন তা নয়, তবে চমৎকৃত হওয়ার মতো কিছু নয়। কিন্তু আসল কথা তো বরাহের মাংসের সূপটি!! সত্যিই সুন্দর ছিলো সেটা, নরম মাংসের সঙ্গে সাম্যাবস্থা বজায় রেখে চর্বির অবস্থান এবং মশলার রোয়াব নেই। মধ্যাহ্নভোজে এরকম একটি ব্যবস্থা থাকলে কান্না পেতেই পারে আনন্দে। 

 ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো, বললেন রাত্তিরে মোটামুটি ৯/৯.৩০ পর্যন্ত খোলা, সাজসজ্জা সাধারণ কিন্তু গোছানো, ছোট্ট আস্তানাটি খরিদ্দারে ভরেই থাকে বলে মনে হলো। যা-ই হোক, পেটপুরে খেয়েদেয়ে এইবার হোটেলে ফেরাই স্থির করলাম, যদি একটু বিশ্রাম নিই। তা ফেরার পথে ম্যালে দাঁড়ালাম, চারপাশের পরিবেশটা দেখতে। একদিকে দোকানপাট (অক্সফোর্ড বুক স্টোর থাকলেও বেশিরভাগ সময় বন্ধই দেখেছিলাম, অবিশ্যি খোলা থাকলেও লোকজন শাসিয়ে রেখেছিলো যেন পা না বাড়াই...), আরেকদিকে একটি রাস্তা নেমেছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়ি "Step Aside" এর দিকে। লোকজন বেঞ্চে বসেই দিব্যি সময় কাটিয়ে দিতে পারে, তবে যা ভিড়! নেপালের জাতীয় কবি ভানুভক্তের মূর্তি এবং তার পেছনে মঞ্চে দেদার সেলফি তুলছে ভ্রমণার্থীরা। মানিকবাবুর সিনেমার দার্জিলিং বোধকরি লুকিয়েছে অন্য কোনোখানে! 

 তা বিকেলে ওখানেই কাটিয়ে নাথুমলের চায়ের দোকানে চা-টা খাওয়া গেলো। ফিরলাম হোটেলের ঘরে, আলাপ হলো ধীরেন বাবুর সঙ্গে। রাত্তিরে মোটামুটি ৭.৩০ নাগাদ নৈশভোজের জন্য রওয়ানা হলাম, তখন ম্যাল মার্কেট জমজমাট, লোকজন কেনাকাটায় ব্যস্ত, ততোধিক অবশ্য দরদাম করতেও বটে। বাঙালির অতি প্রিয় এ-ই কাজটি হয়তোবা মন ভালো করারও উপায়। যা-ই হোক, জাকির হোসেন রোড ধরে কিছুটা হেঁটেই "The Patio", সেখানেই রাতে খাওয়াদাওয়ার প্ল্যান ছিল। কিন্তু পৌঁছে দেখা গেলো নির্দিষ্ট কিছু পদ যা ভেবেছিলাম সেসব রাঁধার মানুষ গৃহ পানে ধেয়েছেন, অতএব থুকপাই সই। তবে, সত্যিই ভেজিটেবল থুকপা আমার ব্যক্তিগতভাবে সুন্দর সুস্বাদু লেগেছিল। নিরালায় বসে ওখানকার পোষ্য কুকুরের সঙ্গে বেড়ালের খেলা দেখতে দেখতে মনোরম শীতল আবহাওয়া আর গরমাগরম থুকপা!! আহ্, এ-ই তো জীবন। 

 অতঃপর, আবারও সে পথ ধরে ফিরে আসা। নিজেরই স্ত্রী যখন, হাত ধরে হাঁটলে কে-ই বা আপত্তি করছে? এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রাতের শহরটিকে দেখলাম উপর থেকে। নির্জনতার একটা মায়াময় রূপ আছে, Solitude has its own charm... এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফিরলাম অ্যালিস ভিলায়, যা দিন কয়েকের জন্য আমাদের আবাসস্থল। 

 পরদিন আবার চিরাচরিত ভাবেই টয়ট্রেন চেপে Steam Joyride... শুয়ে পড়া যাক, তাহলে... 😋

No comments:

Post a Comment