Saturday, January 29, 2022

রকমারী পার্শী খানা, কলকাতায় সেই ঠিকানা

"ইস্তাম্বুল দিয়ে জাপান কাবুল গিয়ে..."; না না, কলকাতায় থাকার একটা দুর্দান্ত সুবিধা হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন রসনার প্রতিনিধি এই শহরে বিদ্যমান। সে ইউরোপীয় হোক, যুক্তরাষ্ট্রীয় হোক, প্রাচ্য, বা পাশ্চাত্যের যে কোনো বিখ্যাত, অথবা অখ্যাতনামা পদ হোক, আমাদের শহর ভালো লাগলে তাকে ভোলেনা৷ 

আমি খেতে ভালোবাসি, পরীক্ষানিরীক্ষাতেও পিছিয়ে থাকতে চাইনা, রাঁধতে পারিনা বটে, কিন্তু খেতে পিছপা নই। এবার হয়েছে কি, আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও খাদ্যরসিকের অভাব নেই, এ এক দারুণ আনন্দের ব্যাপার। এক থেকে দুই, দুই থেকে চার, এভাবে আমাদের দল বেড়েছে। গত সেপ্টেম্বরে আমরা যেমন গিয়েছিলাম চৈনিক খাদ্যের দ্বারা পরিতৃপ্তির সন্ধানে, এইবার আমাদের ইচ্ছে ছিলো, কলকাতার পার্শী খাদ্যসম্ভারের ব্যাপারটা একটু নেড়েচেড়ে দেখি। বন্ধু Saptarshi র কাছে খবর পেয়ে  খোঁজখবর করতে দেখা গেলো, দুটি স্থান আছে, যা কিনা এই ধরনের খাদ্য পরিবেশন করে, তার একটি Manackjee Rustomjee Parsi Dharamshala, যা আমাদের মধ্য কলকাতার বো ব্যারাকের সংলগ্ন। দারা, এবং মেহের হনসোটিয়া, পার্শী দম্পতির তত্ত্বাবধানে এই ধর্মশালায় শহরে আসা পার্শী পর্যটকদের থাকা, এবং সকলের জন্য খাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। আমরা স্থির করেছিলাম আগেই একবার গিয়ে কথাবার্তা বলে আসবো, যা কিছুদিন আগেই সেরে এলাম, সেইমতন দুদিন আগেই মেহের আন্টির সাথে কথা বলে ক'জন আসছি, সেটা বলে নিয়েছিলাম, কারণ এটি টেকনিকালি হোটেল নয়, এবং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে, যা পরে লিখবো। 

যা-ই হোক, গতকাল সকালে আমরা শুরু করলাম নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা, প্রথমে সেন্ট জন্স গীর্জা, এবং সমাধিক্ষেত্র, সেখানে আমরা কিছুক্ষণ কাটালাম। দেখুন, আমি ইতিহাস, বা প্রত্নতত্ত্বের ছাত্র নই, তাই এসব ব্যাপারে বিশদভাবে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু, জোব চার্ণকের সমাধি, তথাকথিত হলওয়েল মনুমেন্ট, কিম্বা অন্ধকূপ–হত্যার স্মৃতিফলক, এবং সর্বোপরি, রাজা নবকৃষ্ণ দেবের দাতব্য জমিতে নির্মিত গীর্জায় বেশ খানিকক্ষণ অতিবাহিত করে মন মোটামুটি ভালোই হচ্ছিলো। কিন্তু, মূল বিষয় হলো পেট, হুম, পেট তখন জবাব চাইতে শুরু করেছে, যে বলি ব্যাপারখানা কি, আজ কি যাবোনা, যাবোনা আমরা?? না, তা বললে কি হয়, তাই আমরা তিনজন চা–ধূমপান সেরে ট্যাক্সিকে বললাম, "চালাও গাড়ি বো ব্যারাকের দিকে!"। চাঁদনী চকে নেমে অলিগলি–চলি রাম–ফুটপাতে চুনকাম দেখতে দেখতে হাজির হলাম সেই জায়গায়, যার জন্য আসা। উষ্ণ অভ্যর্থনায় আমাদের নিয়ে গেলেন মিঃ এবং মিসেস হনসোটিয়া, এবং তাদের আদুরে ককার স্প্যানিয়েল প্রিন্স। 

ডাইনিং হলে আসন পাতা, অর্থাৎ চেয়ার–টেবিল, কাঁটাচামচ প্লেট, ইত্যাদি, দেখে মন বললো, আজ ভালোই হবে ডানহাতের ব্যাপার। শুরুতেই এলো Meher's Special Cutlet. শ্রেডেড চিকেন, সিদ্ধ ডিম, চিজ, কালো গোলমরিচ, এবং কাঁচালঙ্কার মিশ্রণ  দিয়ে তৈরি এই কাটলেট মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়, গোলমরিচের ঝাঁঝ, এবং কাঁচালঙ্কার ঝাল স্বাদ দুর্দান্ত ভারসাম্য দেয় চিজের সাথে মেশানো সিদ্ধ ডিমের। এটি যতই খান, মন ভরবেনা, এ আমি বলতে পারি, বলবে "আরো আরো আরো দাও প্রাণ", কিন্তু এটি তো সবে শুরু। তাই, দ্বিতীয় পদের দিকে হাত বাড়ালাম, এটিও মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি একটি শুরুর দিকের পদ, নাম Chicken Farcha, মূলত ভাজা মুরগির মাংস, বিভিন্ন মশলা দিয়ে, এবং ডিমের আবরণে সজ্জিত। রসালো মাংস, সসের সাথে নেহাৎ মন্দ নয়। প্রতিটি খাবারের বিবরণ, এবং অনুপুঙ্খ দিচ্ছিলেন দারা হনসোটিয়া, আতিথেয়তা, এবং আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। সে যা-ই হোক, আমরা সবাই তখন খাদ্যের স্বাদে আস্তে আস্তে নিজেদের হারাচ্ছি, মন ভালো হচ্ছে। তারপর এলো Patrani Macchi, যা কিনা আমাদের বাঙালি ঘরের পাতুরিরই একটি ভিন্নরূপ। ভেটকিমাছের ফিলেকে সর্ষেবাটা, এবং পুদিনাপাতা বাটা দিয়ে কলাপাতায় মুড়ে তৈরি এই পদ ভালো লাগলো, পাতুরির সাথে অবশ্যই মিল আছে, পুদিনার সুঘ্রাণ নাক থেকে মাথায় যায়। এইসব সূচনা মূলক খাবারের পরে এলো Salli Murgh/ Salli Chicken, যা কিনা মুরগির মাংসের ঝোল, সাথে ঝিরিঝিরি আলুভাজা ছড়ানো, পর্যাপ্ত রসালো মাংস, সেঁকা রুটির সঙ্গে শীতের দুপুরে জমে যাবে। প্রতিটি পদের সঙ্গে যুক্ত আছে আন্তরিকতা, মন না দিয়ে এমন সুস্বাদু রান্নাবান্না, নাহ্, সম্ভব নয়। কিন্তু, মন বলছে, "অভীকবাবু, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি!!"। হুম, তাই-ই বটে, কারণ এইবার এলো মূল পদ Mutton Dhanshak, এটি কিন্তু নেহাৎ সহজ ব্যাপার নয়, কারণ এতে মূল উপকরণ থাকে তিন রকমের ডাল, যথা মুগ, মুসুরি, এবং অড়হর। সাথে পাঁচ রকমের সবজি, লাউ, কুমড়ো, বেগুন, মেথিশাক, এবং পালংশাক। এইসব ডাল, এবং সবজির সঙ্গে দেওয়া হয় মাংস, অর্থাৎ মাটন, যার পরে সবকিছু ঢিমে আঁচে রান্না হয়। এমনভাবে এটি রাঁধা হয়, যে, স্বাদ সবকিছুর পাওয়া যায়, কিন্তু মুখে আটকাবে না, অদ্ভুত সুস্বাদু এই পদটি আগে কখনো খাইনি, স্বাভাবিক ব্যাপার, সাথে ছিলো বাসমতি চালের মশলাদার ভাত, এবং কুচোনো পিঁয়াজ, শশা, এবং টোম্যাটো। এটি খাওয়ার নিয়ম আছে, প্রথমে ভাত নিয়ে থালায়, ছড়িয়ে, তারপর ডালের মিশ্রণ নিয়ে, ভালো করে মেশাতে হবে, তারপর উপরে স্যালাডের কুচি ছড়িয়ে মুখে পুরতে হবে, এবং তারপর? আপনি সপ্তম স্বর্গে চলে যাবেন, সুখের, তৃপ্তির, আনন্দের। আমরা সবাই-ই এই পর্যন্ত খেয়েদেয়ে মুগ্ধ, বলাই বাহুল্য, একটি পদেও কিচ্ছুটি খারাপ লাগেনি। কিন্তু, এটিই শেষ ছিলোনা, কথায় বলে কিনা, মধুরেণসমাপয়েৎ! তাই, সবশেষে এলো Lagan nu Custard, হ্যাঁ, মিষ্টপদ এই কাস্টার্ড বিশেষ এঁদের মধ্যে প্রচলিত, যা বেকিং পাউডার, এবং যে কোনো ধরনের ময়দা বর্জিত। ডিম, এবং দুধ দিয়ে তৈরি, উপরে ছড়ানো ক্যারামেল, এবং সেঁকা কাজুবাদাম। এক চামচ মুখে দেওয়ার পরেই বিশ্বাস করুন, বলতে ইচ্ছে করছিলো, "এ মশাই, ভাবা যায়না!!", অবশ্যই জটায়ুর মতো করে। এই পদটি তৈরি করতে দুদিন সময় প্রয়োজন হয়, এবং সেজন্যই অগ্রিম সংবাদ দেওয়ার কথা বলেন ওঁরা। ততক্ষণে আমাদের উদরপূর্তি সম্পন্ন,  এবং হৃদয়পট মধুময়। কারণ, খেয়েছি অনেক জায়গায়, কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে এমন নিখুঁত বিন্যাসের ফলাফল খুব একটা দেখা যায়না। সবশেষে, আয়োজক দম্পতির সঙ্গে ছবি তুলে তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম, একটি ছোট্ট note লিখে, ভিজিটর্স বুকে, যে, আবার আসবো। 

পরিশেষে, একবার চিরাচরিত প্রিন্সেপ ঘাটে গিয়ে সূর্যাস্তের সাথে দেখা করে গরম একভাঁড় চা, এবং চিরকালীন সিগারেটের সাথে পরিতৃপ্তির সন্ধানে গেলাম, এবং আবারও একটি সুন্দর দিনের অবসান হলো। হুম, রাতে খেলায় জিতে নিদ্রা সুখনিদ্রায় পরিণত হয়েছে, যে কথা ভিন্ন প্রসঙ্গ।


7 comments:

  1. খুব সুন্দর ও গুছিয়ে লেখা।

    ReplyDelete
  2. খালামনির কমেন্টের গভীরতা দেখে মুগ্ধ। বৈঠকি মেজাজের লেখা সব সময়ই ভালো লাগে তাই তোমায় দিলাম ❤️

    ReplyDelete
  3. Khalamonir ashirwaad thaklo.... Nur ami

    ReplyDelete
  4. অপূর্ব লেখনী। ভবিষ্যতে এরকম লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম

    ReplyDelete