Sunday, April 14, 2024

দার্জিলিংয়ের দুয়েক কথা(প্রথম পর্ব)



"চল্, পাহাড়ে যাবি? দুচোখ বিস্ফারিত করে শুনলো বালক..."। না, এমন কোনো চিত্রনাট্য আমার ছোটবেলায় ঘটেনি, ঘটার সম্ভাবনাও ছিলোনা। পাহাড়–সমুদ্র–জঙ্গল বা প্রাকৃতিক যে কোনো আবহের প্রতি আকর্ষিত হওয়ার মতো অন্তর্নিহিত বোধ আমার খুবই সীমিত। বন্ধুবান্ধব, পরিজন ও প্রতিবেশীদের কাছে নানাবিধ সৌন্দর্যের কথা শুনেছি, জেনেছি, সবই ভালো। তা, এসব বলে তো আর সমাজে চলা যায়না। তাই, বিবাহের দিনক্ষণ মিটতে না মিটতেই লোকজন বলতে লাগলো কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা। বিশেষত দিদি আর বিপ্লব দা তো বলেই বসলো যে ওরে বাবা তুই তো খেতেটেতে ভালোবাসিস, তুই একবার দার্জিলিংয়েই ঘুরে এসে আমাদের উদ্ধার কর্! 

 একটু নেড়েচেড়ে, পড়েটড়ে, খোঁজখবর নিয়ে দেখলুম যে শহরটির খাদ্যসম্ভার বেশ ভালো এবং বৈচিত্র্য আছে। নিসর্গের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া যায় বৈকি, সেটা নেহাৎ মন্দ নয়, কিন্তু রসনার তৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে হিমেল হাওয়ার পরশ পেলে সেটাও বেশ ভালোই লাগে কিনা? যাক্, স্থির হওয়ার পরে টিকিট কাটা গেলো পদাতিক এক্সপ্রেসে, সে-ও একেবারে ফাস্টোকেলাস ক্যুপ! অতঃপর, দিন কয়েকের জন্য পানসি... থুড়ি পা চালাও পাহাড়ের গায়ে! 

 রাত্তির ১১.২০তে পদাতিক এক্সপ্রেসের ক্যুপে ওঠার পরে মালুম হলো বাহ্!! এ তো বেড়ে জিনিস, দরজাটা বন্ধ করলেই নিজেদের মতো হয়ে যায়। একটি রাতের মামলা বেশ শান্তিতেই কাটবে। কোনো সহযাত্রীর বায়নাক্কা নেই, উটকো মানুষের চেঁচামেচি নেই, মোবাইলে তারস্বরে গপ্পো বা সীট নিয়ে তক্কো কিস্যু নেই! সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামার পরে গাড়ির জন্য সামান্য অপেক্ষা। পরিচয় হলো ড্রাইভার দাদা নারায়ণের সঙ্গে, গল্প করতে করতে যাত্রাশুরুর ক্ষণ বয়ে চললো। এখানে বলা দরকার একজন ছোকরার কথা। তার নাম সুজিত চন্দ। শিলিগুড়ির ছেলে, আমাদের পরিচিত হয়েছে এ-ই সামাজিক মাধ্যমের একটি মঞ্চে যার সংক্ষিপ্ত নাম CBG.. কিন্তু দীর্ঘ দশ বছর পরে এ-ই পরিচয় সাক্ষাৎে পরিণত হলো এই সফরে। ওকে আমাদের বেড়াতে যাওয়ার কথা জানানোর পরে একটিবারের জন্যও চিন্তা করতে হয়নি গাড়ির জন্য কিম্বা যাত্রাপথের খাবারের জন্য, এতো দায়িত্বশীল এবং সদাহাস্য। জবা, অর্থাৎ সুজিতের সহধর্মিণী, সে-ও তেমনই, মানে ওরা একে অপরের পরিপূরক। 

 পথে একবার চা-সিগ্রেট নিয়ে দার্জিলিং পৌঁছালাম দুপুর দেড়টা নাগাদ। দুপাশে দূর থেকে চা-বাগান এবং পাইন গাছ ইত্যাদি দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো বলাই বাহুল্য। এরপর এলো পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা। না, হৃদয়ে শিহরণ জাগেনি, কিন্তু রোমাঞ্চকর তো বটেই খানিকটা। মাঝে কার্শিয়াঙে একবার গাড়ি দাঁড়ালো, দুয়েকটা ছবি তুলে নিলুম স্মৃতির জন্য। সস্ত্রীক প্রথমবারের জন্য কোথাও এসেছি, পরে কাজে লাগতেই পারে। 

 আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল অ্যালিস ভিলায়। দার্জিলিংয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ ম্যাল পেরিয়েই এ-ই বিলিতি ধাঁচের হোটেলটি। ম্যানেজার সদা হাস্যমুখ ধীরেন প্রধানের অনুপস্থিতিতে আমাদের স্বাগত জানালেন দীপেন বাবু(অচিরেই উনি দীপেন দা হয়ে উঠবেন)। ঘরটি দেখে মন ভালো হয়ে গেলো। তেতলার একটি প্রান্তে, নিরিবিলি ছিমছাম ঘর, সংলগ্ন বারান্দা। হ্যাঁ, আমার বাপু ঘরের বিছানা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন করার বাসনা না থাকায় সেরকম বসবাসের জন্য স্থান সন্ধান করিনি। 

 তা ঘরে ঢুকে স্নান সেরে বেরোলাম দুপুরের খাবার খেতে। ঠিক করে রেখেছিলাম প্রথম দিন হয় কেভেন্টার্স যাবো, নয়তো মোহন'স। তা সেদিন ছিলো বিষ্যুদবার, অতএব কেভেন্টার্স বন্ধ থাকায় পাশের রাস্তাতেই ছোট্ট ছিমছাম মোহন'সেই ঢুঁ মারলাম। এখানে মূলতঃ নেপালী খাদ্যের সন্ধান করা লোকজন আসেন এবং আমরা সেটাই করতে গেছিলাম। আমি বললুম নেপালী পর্ক থালি এবং আমার স্ত্রী, যিনি আমিষাশী হলেও দুরকম মাংসেই সীমাবদ্ধ আছেন তিনি চিকেন থালিই বললেন। থালিতে সাদা ভাতের সঙ্গে হরিদ্রাভ ভাতের দর্শন হলো ; ভদ্রলোক নিজেই জানালেন ওটি মকাইয়ের চালের ভাত। সাথে সাথে ছিলো নেপালী একটি শাকভাজা, মকাইয়ের স্যুপ( ডালের পরিবর্তে আরকি, তবে পাতলা ও স্বচ্ছ), ছোট ও গোল আলু যা কিনা মেটে আলুভাজা জাতীয়, পাঁপড়, স্যালাড ও কচ্ছুম্বর স্যালাড,  আচারএবং মধ্যমণি পর্কের ঝোল। অন্যান্য পদগুলো কিছুটা আলাদা বা অনভ্যস্ত বলে যে স্বাদহীন তা নয়, তবে চমৎকৃত হওয়ার মতো কিছু নয়। কিন্তু আসল কথা তো বরাহের মাংসের সূপটি!! সত্যিই সুন্দর ছিলো সেটা, নরম মাংসের সঙ্গে সাম্যাবস্থা বজায় রেখে চর্বির অবস্থান এবং মশলার রোয়াব নেই। মধ্যাহ্নভোজে এরকম একটি ব্যবস্থা থাকলে কান্না পেতেই পারে আনন্দে। 

 ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো, বললেন রাত্তিরে মোটামুটি ৯/৯.৩০ পর্যন্ত খোলা, সাজসজ্জা সাধারণ কিন্তু গোছানো, ছোট্ট আস্তানাটি খরিদ্দারে ভরেই থাকে বলে মনে হলো। যা-ই হোক, পেটপুরে খেয়েদেয়ে এইবার হোটেলে ফেরাই স্থির করলাম, যদি একটু বিশ্রাম নিই। তা ফেরার পথে ম্যালে দাঁড়ালাম, চারপাশের পরিবেশটা দেখতে। একদিকে দোকানপাট (অক্সফোর্ড বুক স্টোর থাকলেও বেশিরভাগ সময় বন্ধই দেখেছিলাম, অবিশ্যি খোলা থাকলেও লোকজন শাসিয়ে রেখেছিলো যেন পা না বাড়াই...), আরেকদিকে একটি রাস্তা নেমেছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়ি "Step Aside" এর দিকে। লোকজন বেঞ্চে বসেই দিব্যি সময় কাটিয়ে দিতে পারে, তবে যা ভিড়! নেপালের জাতীয় কবি ভানুভক্তের মূর্তি এবং তার পেছনে মঞ্চে দেদার সেলফি তুলছে ভ্রমণার্থীরা। মানিকবাবুর সিনেমার দার্জিলিং বোধকরি লুকিয়েছে অন্য কোনোখানে! 

 তা বিকেলে ওখানেই কাটিয়ে নাথুমলের চায়ের দোকানে চা-টা খাওয়া গেলো। ফিরলাম হোটেলের ঘরে, আলাপ হলো ধীরেন বাবুর সঙ্গে। রাত্তিরে মোটামুটি ৭.৩০ নাগাদ নৈশভোজের জন্য রওয়ানা হলাম, তখন ম্যাল মার্কেট জমজমাট, লোকজন কেনাকাটায় ব্যস্ত, ততোধিক অবশ্য দরদাম করতেও বটে। বাঙালির অতি প্রিয় এ-ই কাজটি হয়তোবা মন ভালো করারও উপায়। যা-ই হোক, জাকির হোসেন রোড ধরে কিছুটা হেঁটেই "The Patio", সেখানেই রাতে খাওয়াদাওয়ার প্ল্যান ছিল। কিন্তু পৌঁছে দেখা গেলো নির্দিষ্ট কিছু পদ যা ভেবেছিলাম সেসব রাঁধার মানুষ গৃহ পানে ধেয়েছেন, অতএব থুকপাই সই। তবে, সত্যিই ভেজিটেবল থুকপা আমার ব্যক্তিগতভাবে সুন্দর সুস্বাদু লেগেছিল। নিরালায় বসে ওখানকার পোষ্য কুকুরের সঙ্গে বেড়ালের খেলা দেখতে দেখতে মনোরম শীতল আবহাওয়া আর গরমাগরম থুকপা!! আহ্, এ-ই তো জীবন। 

 অতঃপর, আবারও সে পথ ধরে ফিরে আসা। নিজেরই স্ত্রী যখন, হাত ধরে হাঁটলে কে-ই বা আপত্তি করছে? এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রাতের শহরটিকে দেখলাম উপর থেকে। নির্জনতার একটা মায়াময় রূপ আছে, Solitude has its own charm... এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফিরলাম অ্যালিস ভিলায়, যা দিন কয়েকের জন্য আমাদের আবাসস্থল। 

 পরদিন আবার চিরাচরিত ভাবেই টয়ট্রেন চেপে Steam Joyride... শুয়ে পড়া যাক, তাহলে... 😋

Wednesday, April 26, 2023

বেনারস : শুরুর শুরু (দ্বিতীয় পর্ব)


বহুলব্যবহৃত রবীন্দ্রনাথের "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশিরবিন্দু"... এটির আশ্রয় নিতেই হল। 

রবীন্দ্রনাথ তো একমাত্রিক কথা বলতেন না, এক্ষেত্রেও ধানের ক্ষেত শুধু নয়, দিশি/ঘরোয়া/নিতান্তই আটপৌরে আপনার কিছুকেই উপেক্ষা করে হাটে-বাজারে দৌড়ে সুখ-শান্তি খুঁজে বেড়ানোর কথাও বলেছেন মনে হয়। কিন্তু আমি তো একটু অলস, ঘোরাঘুরি করার নামে বেজায় জ্বর আসে! বেনারস অবশ্য ব্যতিক্রম, কারণ আগেই বলেছি। 

সময়ের সাথে সাথে যাত্রার বাহনের ধরণের পরিবর্তন, অভিযোজন তো হয়েছেই; সড়ক–জল–রেল–আকাশ কিছুই আর আয়ত্তের বাইরে নয়। কিন্তু আমি জানেন, রেলের যাত্রা কেই বেশি পছন্দ করি। রাত্তিরে যখন চারপাশটা নিঝুম হয়ে আসে, তখন ছোট্ট কোনো স্টেশন সাঁইসাঁই করে পেরিয়ে যাওয়া রেল... অন্ধকার জানালার ভেতর থেকে টিমটিমে আলো জ্বলা স্টেশন চত্বরটা, ফাঁকা বেঞ্চ, নীল–লাল অথবা হলদে–কালোয় লেখা অক্ষরগুলো চেষ্টা করে পড়ে ফেলা... অদ্ভুত আনন্দ হয়। আবার সে যদি হয় বড়ো কোনো স্টেশন, অথবা জংশন.. যাত্রীদের হাঁকডাক, নামা অথবা ওঠার জন্য তাড়া, ফেরিওয়ালার ডাক "চায়ে গ্রম.... এই-ই চায়েএএ", আবার মিনিট কয়েক পরে ঘুমিয়ে পড়া স্টেশনটি অপেক্ষা করে থাকে পরের সোয়ারি দেখার। আমাদের ট্রেনের সফর ছিল ১৩ ঘন্টার, বেশ আরামদায়ক এবং স্বস্তিকর। ট্রেন লেট করলে আবার মেজাজ বেগড়ানো... সে ভারী খারাপ ব্যাপার!! তা সে ট্রেন হাওড়া স্টেশন ছাড়লো রাত্তির আটটায়, আর আমাদেরও যাত্রা শুরু হলো। প্রথম স্টপ বর্ধমান হয়ে আস্তে আস্তে দুর্গাপুর, আসানসোল, চিত্তরঞ্জন হয়ে প্রবেশ করলো বিহারে। জসিডি, কিউল, মোকামা... স্টেশনগুলো দেখতে দেখতে ছোটবেলায় পড়া পূজাবার্ষিকীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো যেখানে লীলা মজুমদার, সুনির্মল বসু, হেমেন রায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়দের লেখায় এই জায়গাগুলোর নাম পড়তাম। ট্রেনের যাত্রা আমাদের বেশ ভালোই কেটেছে দু তরফেই। পরদিন সকালেই তো সে-ই আকাঙ্ক্ষিত স্থান... বেনারস!

জয় বাবা ফেলুনাথ, জয় বাবা মানিকনাথ..... সবই তো তোমাদের ভরসায়, আসাটা যেন মনে থাকে। এইসব ভাবতে ভাবতে ট্রেন এসে দাঁড়ালো বেনারস স্টেশনে। আমাদেরও এই ছোট্ট সফরের গৌরচন্দ্রিকা পেরিয়ে মূলপর্ব শুরু হবে। আহহ্, শান্তি!! Debanjan Chatterjee আর Sudipta Saha Avi দার সঙ্গে নেমে অগ্রসর হলাম হোটেল অলকায় যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি ঠিক করতে। সঙ্গে লটবহর তো কিছু ছিলোনা মাথাপিছু একটি ব্যাগ, অতএব চলো পানসি বেলঘড়িয়া, থুড়ি বারাণসী। 😊

ক্রমশ....

Monday, April 24, 2023

"বেনারসের টুকিটাকি" (পর্ব ১)


কিতনি মুবারক হ্যায় ইয়ে শাম, অপনো সে অপনে মিলে হ্যায়ঁ.... 

হ্যাঁ, মিলন–আলাপ–আপনজনের সাথে ; সে হতে পারে মানুষের সাথে মানুষের, অন্য প্রাণীর সাথে, গাছের সাথে অথবা সবকিছু নিয়ে অপেক্ষায় থাকা কোনো জনপদের সাথেও! কাউকে যেমন দেখলে মনে হয় কতকালের চেনা, তেমন কিছু কিছু জায়গাতেও সেই টান থাকে হে! নইলে আমার মতো ঘরকুনো, অলস একজনকে নিয়ে যায় ঘরের থেকে নয় নয় করে সাতশো কিলোমিটার দূরে? কিছু দায় অবশ্য মানিকবাবুরও রয়েছে; জয় বাবা ফেলুনাথ পড়ে, সিনেমায় দেখে আরো কৌতূহল জাগলো যে! ফেলু মিত্তির বলেছিলেন কিনা "কাশী ইজ বেঙ্গলী'জ সেকেন্ড হোম লালমোহন বাবু।"

বারানসী, বেনারস, কাশী যে-ই নামই হোক, প্রায় বছর খানেক আগেই একবার অন্তত ঘুরে আসার ইচ্ছে জেগেছিল। আমার সাধারণত এরকম ইচ্ছে হয়না, কিন্তু এইবেলা হয়েছিল। কিন্তু কি জানেন, আমার বেড়ানোর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হলো সঙ্গী। হুম, আমি একটু একঘেয়ে, বদমেজাজী, খাপছাড়া... তা-ই সঙ্গীকে অনেককিছুই মানিয়ে নিতে হবেক! তা সেরকম লোকজন কি হাটেবাজারে মেলে? কে স্বেচ্ছায় ঝামেলা পোহাতে চায় মশাই? তা সে যা-ই হোক, বাল্যবন্ধু  Debanjan Chatterjee র সাথে অনেকবারই আলোচনা হয়েছে ঘুরে আসা নিয়ে, কিন্তু হয়ে উঠছিলো না! সাথে Santanava Roy বাবু, Sudipta Saha Avi আর Kaushik Chakraborty দা'রও আসার কথা হচ্ছিলো। তবে এই বচ্ছর আসার পরেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, হ্যাঁ "উঠলো বাই তো কাশীই যাই"! ওখানকার খাদ্যসম্ভারের নানা খোঁজ পেয়েছিলাম, অলিগলিতে হয়তোবা অনেক অজানা কাহিনীর সন্ধান পেতে পারি, আর ঐ যে, নিজেদের সেকেন্ড হোম দেখে আসার লোভ.... একসাথে এতসব টুকরো হাসির ফোয়ারার আয়োজন কি সামলানো যায়? আমি তো মানুষ নাকি? তাই আমি, দেবাঞ্জন আর সুদীপ্ত দা ঠিক করলাম এইবার এপ্রিলের মাঝামাঝি, অর্থাৎ কিনা নববর্ষের প্রাক্কালে একবার দর্শন করে আসি সভ্যতার প্রাচীনতম এই নিদর্শন শহরটিকে। রায় বাবু আর রাণা দা এলে আরো জমতো কিন্তু বাধ সেধেছিল কিছু কাজ কিছু কাল... সে তো কিছু করার নেই! ট্রেনের নাম বিভূতি এক্সপ্রেস, স্টেশনের নাম চিরকালীন... হাওড়া। 

আমাদের যাত্রা শুরু এবং শেষের মেয়াদ বেশ ছোট, ১২ই এপ্রিলের বিকেল থেকে ১৬ই এপ্রিলের সকাল। অতএব, দায়দায়িত্ব কতটা বেড়েছিলো ভাবতেই পারছেন!! এই কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সূত্রে ওখানকার রসনা তৃপ্তির হরেক ঠিকানা জোগাড় করা, ওখানকার ঘাট–রাস্তা–গলি–স্থাপত্যের দর্শন, আর আশেপাশের কিছু কিছু জায়গা পত্র দেখে সুস্থ শরীরে ফেরা; কারণ গ্রীষ্মকাল তো কারোর অধীনস্থ কর্মচারী নয়, আর আমাদের জামাইও নয় যে খাতির করবে! যা-ই হোক, শুরু থেকে শেষ... হলো ভালোই। 

একটি কথাই বলবো, বেনারসের মতো উচ্ছলিত, দিলখোলা, পুরাতনী ও আধুনিকতার বহমানা ধারাকে একইভাবে উজ্জ্বল রাখা শহর সম্পর্কে না গেলে কিস্যুই ধারণা করা যায়না! শুধু মন্দির আর জয়ধ্বনি নয়, ঘাট আর গলির ভিড় নয়; ওখানে প্রাণ আছে, তুমুল প্রাণের সঞ্চার আছে... দেখি, নিজের সীমিত ক্ষমতায় কতটা তার তুলে ধরতে পারি। পরবর্তী পর্ব নিয়ে শিগগিরই আসছি... কয়েকটা দিনের তো অপেক্ষা মোটে.... থাকছেন তো সঙ্গে?? ☺️

Monday, April 10, 2023

একটু ভাজাভুজি, একটু অনিয়ম 😋


কলকাতার অনেক কিসিমে’র নাম আছে। সে কল্লোলিনী তিলোত্তমা থেকে শুরু করে নেহরুর বলা মিছিলনগরী... ইতিহাসের কিছুই এর না-দেখা নয়। কিন্তু আমি বলি আমার শহর খাদ্যনগরী। হ্যাঁ, হেন জায়গা নেই যেখানকার খাদ্যসম্ভার এখানে অমিল, আর কিছু কিছু ব্যাপারে তো কলকাতার জুড়ি মেলা ভার। আমি চিরকালই খেতে ভালোবাসি আর এই ভাজাভুজির দিকে ঝোঁকটা বেশিই। নোনতা স্বাদই জিভে ঠেকেছে, কি আর করা! কদিন ধরেই তাই ভাবছিলাম উত্তর কলকাতার দুয়েকটা নামজাদা ঐতিহ্যবাহী স্থান দর্শন করে আসার। সে আর হয়ে ওঠেনা, কিন্তু আজ মওকা পেয়ে দলবেঁধে গেলাম আস্বাদন গ্রহণ করতে। আজ আমাদের দল বেশ ভারীই ছিলো। আমি, Debanjan, Koushiki দি, ChiranJoy, Arijit Ghosh দা, Sudipta দা, Jayee দি.. সঙ্গে Snehasish এবং Anwesha অফিসফেরত সোজা যোগ দিলো। সঙ্গে পেয়ে গেলাম পথে যেতে যেতে Pial আর Roy বাবুকে, দুপুরে বলেছিলো হয়তোবা চলে আসতেও পারে!! তা যা ভাবা সেইমতন সবাইকে বলে দিয়েছিলাম নিরঞ্জন আগারের সামনেই সাক্ষাৎ করতে। 

আমাদের এতজনের জন্য তো আর চেয়ার-টেবিল খালি রেখে বসে থাকবেন না তাঁরা, অগত্যা বেশ খানিকটা অপেক্ষা করে বসার সুযোগ পেলাম বটে, কিন্তু বিধি বাম! ১৯২২ এ স্থাপিত এই বিখ্যাত রেস্তোরাঁয় বিষ্যুদবার সেখানকার সিগনেচার আইটেম ডিমের ডেভিল হয়না!! কি করা যায়? কুছ পরোয়া নহী, বলা হলো ফাউল কাটলেট আনতে। সত্যিই দুর্দান্ত খেতে, মুচমুচে এবং সুস্বাদু। তারপর দোনোমোনো করে ডিমের চপ অর্ডার দিলাম, কিন্তু না!! ওটি ভালো লাগেনি একেবারেই, বেসনের আস্তরণে ডিম ঠিক জমলো না। একদিন অন্য বারে এসে ডেভিল গ্রহণ করতে হবে ভেবে দ্বিতীয় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। এইবার আমরা যাবো অ্যালেন কিচেন। 

১৯২৫ এর অ্যালেন কিচেনেও খানিকটা সময় অপেক্ষা করার পরে জায়গা পেলাম, কারণ একসঙ্গে এতজনকে স্থান সঙ্কুলান করাটাও মুশকিল কিনা! খুব বেশিক্ষণ নয় অবশ্য, অর্ডার দেওয়া হয়েছিল এখানকার বিখ্যাত পদ চিংড়ির কাটলেট। উলস্!! ঘিয়ে ভাজা চিংড়ির এই কাটলেট স্রেফ চমৎকার বললেও বিবরণ দেওয়া যায়না মশাই, গিয়ে খেয়ে আসতে হবে। যাক, ডিমের চপের দুঃখ অচিরেই ভুলতে পারছিলাম বৈকি। ততক্ষণে আবার টিপটিপ দুফোঁটা গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। যা-ই হোক, দুয়েক ঢোঁক ঠাণ্ডা পানীয়ে চুমুক দিয়ে এইবার আজকের তৃতীয় তথা শেষ গন্তব্য, মণি রেস্তোরাঁ।

পটলার কচুরির অদূরেই এই ছোট্ট আস্তানাটি আজকের অভাবনীয় হিরো/হিরোইন/সেন্ট্রাল ক্যারেক্টর। এমন সুস্বাদু মাছের কচুরি, তাও মাত্র ১০/-(দশ) টাকায়, সত্যি বলছি ভাবতেই পারিনি। বলরাম বাবুর নাম, কারিগরী মাধুর্য আমি শুনেই ছিলাম সুদীপ্ত দার কাছে, আজ একেবারে হৃদয়ে পশিয়া গেলো। ফাউল কাটলেট যদি হয় শেহওয়াগের ভয়ডরহীন ব্যাটিং, ডিমের চপ একেবারে সদাগোপান রমেশ। চিংড়ির কাটলেট ধ্রুপদী রাহুল দ্রাবিড় আর মণি রেস্তোরাঁর মাছের কচুরি? আমার মতে আনসাং হিরো ভিভিএস লক্ষ্মণ। তারপর অবশ্য মিষ্টিমুখের পালা, বড়ো ভালো কাঁচা আমের স্বাদের সন্দেশ টুকটুক করে খান দুয়েক পেটে পুরে মধুরেণসমাপয়েৎ হলো। আজ এতজন একসাথে মিলে হইহই করে সন্ধ্যাটা বড়ো সুন্দর কাটলো। 

আবার একদিন হবে, শীতের সন্ধ্যায়। ফেরার পথে এইসব আলোচনা করতে করতেই দক্ষিণের বৃষ্টি গায়ে মেখে বাড়িতে। এ এক দারুণ আনন্দের ব্যাপার বটে। 😍

Monday, January 23, 2023

কোরিয়ান ফুড ট্যুরের ইতিউতি

খাদ্য সফরের কোরিয়ান পর্ব/কোরিয়ান ফুড ট্যুর। 

মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই, থাকার কথাও নয়। নিত্যনতুন পরিভাষা যে কোনো বিষয়েরই হোক না কেন, একটা আগ্রহ জাগলেই সেটা নিবৃত্ত করার জন্য সচেষ্ট হয় তারা। আমাদের কয়েকজনের আগ্রহ খাবারদাবার নিয়ে, হ্যাঁ, চর্ব্যচোষ্য লেহ্যপেয়র মধ্যে যা অজানা, অচেনা, স্বাদ পাওয়া হয়নি, সেটা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাতে পিছপা হইনা। 

ইদানীং দক্ষিণ কোরিয়ার বেশকিছু বিষয় আমাদের চারদিকে জনপ্রিয় হয়েছে। তার মধ্যে যেমন সিনেমা, ওয়েব সিরিজ বা কোরিয়ান পপসঙ্গীত আছে, তেমনই আছে কোরিয়ান খাদ্যসম্ভার। তা, কলকাতায় খুব সম্প্রতি কিছু খাদ্য স্থান খুলেছে এই দেশের খাবার নিয়ে, তারই মধ্যে একটি হলো King's Bakery.. এখনো পর্যন্ত চারটি শাখা আছে যার মধ্যে তিনটি (পূর্ণদাস রোড, বালিগঞ্জ এবং যোধপুর পার্ক) দক্ষিণ কলকাতায়, আরেকটি রাজারহাটে। কয়েকদিন আগেই আমার সাথে কয়েকজন খাদ্যরসিক বন্ধুবান্ধবদের আলোচনা হচ্ছিলো একবার সেখানের একটি শাখায় যাওয়াটা কর্তব্য। তা যে ভাবনা আসে, সেটা ফলপ্রসূ করতে গেলে যা যা করণীয়, তা করা হলো। প্রিয়াঙ্কা পূর্ণদাস রোডে খোঁজ নিয়ে আমাকে জানানোর পরে আমরা স্থির করলাম আজকের দিন, অর্থাৎ ২২শে জানুয়ারী একবার গিয়ে একটু চেখে আসা যাক এই দেশের কুইসিন। 

কোরিয়ার খাবারের মূল উপাদান চাল। হুম, এশিয়ার বেশিরভাগ দেশের মতই সেখানে চালের বিভিন্ন প্রকারভেদের রূপদান পায় খাদ্যের মধ্যে। সাথে থাকে মাছ, মাংস, এবং বিভিন্নরকম সবজির সম্ভার। রান্নায় কিছু পরিমাণ সয়াসস আর কালো বীনের সস ব্যবহৃত হয় খোলতাই স্বাদের জন্য। ভাতের ধরণ খানিকটা আঠালো, নরম চালের। কোরিয়ার মিষ্টি কিম্বা ডেসার্ট পদেরও বেশ সুনাম আছে দেখলাম। সে কথায় আসছি পরে। 

কথা অনুযায়ী আমরা কজন, অর্থাৎ কৌশিকী দি, প্রিয়াঙ্কা, চিরঞ্জয়, চিরঞ্জয়ের স্ত্রী রিম্পা, ছোট্ট রিয়ান, বন্ধু সুরিত, সুদীপ্ত দা এবং আজকের চমক, অলস ঘরকুনো চমৎকার রন্ধনশিল্পী বিপ্লব দা এবং এই শর্মা!! বিপ্লব দা আজকের সফরে সঙ্গী হতে চেয়েছে এ এক দারুণ আশ্চর্যের ব্যাপার। নিজে ভালো রাঁধে বলেই নয়, এই ভদ্রলোক অফিস ছাড়া কোথাও যেতে একেবারেই চায়না। সে ভালো কথা, মোটামুটি সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমরা পৌঁছালাম ওখানে। সুন্দর সাজসজ্জা, আসবাবপত্র এবং কর্মচারীদের ব্যবহার, ভালো লাগলো। শীত তো কলকাতার মায়া প্রায় ত্যাগ করেইছে, তা আর কি করা যাবে? মেন্যু দেখেশুনে ঠিক করা গেলো অর্ডার দেওয়া হবে নানারকম পদ, যাতে বৈচিত্র্য আর স্বাদের ধরণ পরখ করা যায় ঠিকঠাক। 
তাই, 

১) 𝙏𝙪𝙣𝙖 𝙂𝙞𝙢𝙗𝙖𝙥 (চালের সঙ্গে টুনা, গাজর, শশা, বাঁধাকপি ইত্যাদি সবজির মিশ্রণের চাকতি, মোড়কটা সামুদ্রিক শৈবালের চাদরের, যাকে বলে gim).. কালো বীনের সস সহযোগে খেতে মন্দ নয়। 

২) 𝙆𝙞𝙢𝙘𝙝𝙞 𝙂𝙞𝙢𝙗𝙖𝙥 (একইরকম, শুধু টুনার বদলে কাঁকড়ার মাংস থাকে)।

৩) 𝙆𝙞𝙢𝙘𝙝𝙞 𝙁𝙧𝙞𝙚𝙙 𝙍𝙞𝙘𝙚 (কিমচি ব্যাপারটা হলো কোরিয়ার প্রথাগত একটি পদ, যাতে নাপা বাঁধাকপি, কোরিয়ান মুলো, গাজর ইত্যাদি কে গাঁজন করে ব্যবহার করা হয় রান্নায়)। বেশ ভালো লেগেছে। 

৪) 𝙏𝙩𝙚𝙤𝙠–𝙗𝙤𝙠𝙠𝙞 (চালের তৈরি এক ধরনের পিঠে যা সিদ্ধ মাছ, ডিমের সাদা অংশ এবং কিছু সবজির অংশ, যেমন পেয়াঁজকলি দিয়ে বানানো হয়, গাঢ় ঝোলের মধ্যে ), এটির স্বাদ মিষ্টি খানিকটা। 

৫) 𝙅𝙖𝙮𝙪𝙠 𝘿𝙚𝙤𝙥𝙗𝙖𝙥 (যারা পর্কপ্রেমিক, তাদের জন্যে চমৎকার একটা পদ, খুব সহজ, শুয়োরের মাংসের কারি, আর ভাত), ঝালমিষ্টির সাযুজ্য রয়েছে, সুস্বাদু। 

৬) 𝙍𝙖𝙢𝙮𝙚𝙤𝙣 (এগ চিকেন স্পাইসি বলা হয়েছিল যাতে একটু ঝালঝাল কিছু একটা হয়.. নাহ্, সে হয়নি, নুডলস হিসেবে সাধারণ স্বাদের)।

এসবের পরে এলো ডেসার্টের পালা। এখানে এটির সম্ভার বেশ ভালো, আমরা নিয়েছিলাম 𝘾𝙖𝙧𝙧𝙤𝙩 𝘾𝙝𝙚𝙚𝙨𝙚 𝘾𝙖𝙠𝙚, 𝙀𝙜𝙜 𝙏𝙖𝙧𝙩 এবং 𝘾𝙧𝙚𝙖𝙢 𝘾𝙝𝙤𝙪𝙭 (ক্রীম ভরা ছোট ছোট বান).. আর আমি তো কোনো জায়গায় চা পেলে চাখতে ছাড়িনা, তাই 𝙎𝙪𝙟𝙚𝙤𝙣𝙜𝙜𝙬𝙖(𝘾𝙞𝙣𝙣𝙖𝙢𝙤𝙣 𝙋𝙪𝙣𝙘𝙝)চেখে দেখলাম বিপ্লব দার সাথে। সে এক দারুণ অদ্ভুৎ বটে, তা দারুচিনি আর কেমনই বা হবে?? 

সব মিলিয়ে আড্ডা, গল্প, নতুন ধরনের খাবার.. একটা ভালো সন্ধ্যা কাটলো। হ্যাঁ, পেটের জন্য বন্ধুমনোভাবপন্ন খাবার, আমার বেশ ভালোই লেগেছে। আবারও কখনো আসা হবে বৈকি, কারণ আজ অনেকেই বিভিন্ন কারণে আসতে পারলোনা। ততক্ষণ, ভালো খাবারের কথা ভেবে মন ভালো করা যাবে। পরিশেষে, যার কথা না বললেই নয়, সে হলো রিয়ান। পুরোটা সময় একবারও অধৈর্য্য বোধ করেনি, বেচারা বড়দের খাবারদাবার খেতেও পারেনি, মিষ্টি জাতীয় ওয়্যাফল আর টার্ট খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে, কিন্তু রীতিমতো এনার্জি নিয়ে সঙ্গ দিয়েছে সব্বাইকে। বড়ো হলে অবশ্য ওকে নিয়ে খেতেটেতে বেরোবো, হি ইজ আ সুইটহার্ট।😃❤️


Friday, September 30, 2022

অথ কচুরি কাহিনী


ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য সারার পরে প্রাতঃরাশ, এই দিয়েই দিনের শুরু হয়, আর ইংরেজিতে একটা প্রবাদই আছে morning shows the day. আজকাল তো এই জলখাবারের নানান ধরণ এসেছে, সারা বিশ্বের খাদ্যাখাদ্য ডাইনিং টেবিলে শোভা পায়। তার উপর রয়েছে ডায়েটিংয়ের বাঁশি। তা সে যা-ই হোক না কেন, ভোরবেলার ঝলমলে রোদ আরেকটু উজ্জ্বল হয়ে যায় কি দেখে? আরকিছুই নয়, কড়াইয়ে ঘি অথবা ডালডায় ভাজা সোনালী লালচে গোলাকার বস্তু দেখে; যার নাম কচুরি।

অরিজিৎ ঘোষ দার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো সকালবেলায় বিভিন্ন জায়গায়, তা সে উত্তর হোক বা দক্ষিণ কলকাতায়, কচুরি খাবে। একাজে সেকাজে সেটা কিছুদিন পিছিয়ে গেলেও মাথায় ছিলো বৈকি৷ কিন্তু, আমাদের জীবনের আরেকটি অঙ্গ তো আলস্য, সেটা ঠেকিয়ে এতো সকালে ছুটোছুটি করাও তো কঠিন। তাই, প্রায় চার মাস পরে আজ আমরা ক'জন বেরিয়ে পড়েছিলাম এই শুভকাজ সম্পন্ন করতে। রায় বাবু সামান্য অসুস্থ থাকায় যোগ দিতে পারেনি। তাই, আমাদের দেবাঞ্জন, সুদীপ্ত সাহা দা, অরিজিৎ ঘোষ দা আর এই অধম বেরিয়ে পড়লাম কচুরি অভিযানে। 

শুরুটা করলাম হরিশ মুখার্জি রোডের বিখ্যাত বলবন্ত সিংয়ের ধাবায়। অতিপরিচিত এই খাদ্যালয়ে হিংয়ের কচুরি আর আলুর তরকারি, কাঁচালঙ্কার আচার সহযোগে, কার না ভালো লাগে? এক প্লেটে চারটি গরমাগরম কচুরি, তারপর ভাঁড়ে গরম চা, মেজাজ খুশ হয়ে গেলো যাকে বলে! কিন্তু, সাথে আরেকটি কথাও আলোচনা করে নিলাম যে এরপরে তো আরো দুয়েকটা জায়গায় যেতে হবে, তাই ভাগযোগ করে খাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। 

Balwantsinghdhaba, kolkatastreetfood, foodblogger, foodblog, kolkata, bengaliblogger

Balwantsinghdhaba, kolkatastreetfood, foodblogger, foodblog, kolkata, bengaliblogger

অতঃপর ট্যাক্সি ছুটলো শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের আদি হরিদাস মোদকের দিকে। এটিও সুপ্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী এবং অত্যন্ত পরিচিত বটে। প্রায় ২৫০ বছর ধরে ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া এই স্থানের ব্যতিক্রমী চেহারা হলো পরিবেশনের ধরণে, কলাপাতায়। সেখানে পাওয়া গেলো কচুরি, এবং ছোলার ডালের তরকারি। বেশ সুস্বাদু, চটজলদি জায়গা পাওয়া যায়না সেটাই স্বাভাবিক। এখানে মোটামুটি খান তিনেক কচুরি গলাধঃকরণ করে ধীরেসুস্থে জলপানের পরে একটি সিগারেট ধরালাম।  

HaridasModak, kolkatastreetfood, foodblogger, foodblog, kolkata, bengaliblogger

উত্তর কলকাতায় এসে একটু গঙ্গা দর্শন না করলে কি হয়? তাই, পদব্রজে টুকটুক করে এগোলাম বাগবাজার মায়ের ঘাটের দিকে। সেখানে গঙ্গা পাড়ে বসে খানিকক্ষণ হাওয়া খেয়ে যাবো পটলার কচুরির পানে। পটলার কচুরি...... বাগবাজার গিয়েছেন অথচ এখানে ঢুঁ মারেননি এরকম লোক কে জানে আছে কিনা! ৯৩ নট আউট, স্টেডি ফুটস্টেপ, এবং অসাধারণ লাইন ধরে ড্রাইভ করে চলেছে। আহা, শীতকালের দোরগোড়ায় এসে একটু ক্রিকেটের উপমা দেওয়াই যায়, কি বলেন? এখানে কচুরির সাথে তরকারির স্বাদে আরেকটু প্রচলিত ধরনের ছোঁয়া পেলাম। ততক্ষণে পেট বেশ ভরেছে, এবং মন তো অবশ্যই। 

PotlarKochuri, kolkatastreetfood, foodblogger, foodblog, kolkata, bengaliblogger

কিন্তু, সব ভালো যার শেষ, তাই না? তা এদিকে এসে পুঁটিরাম হবেনা? না না, আমরা তেমনটা ঠিক নই। অতএব, করলে স্কোয়ারে অল্পসময় জিরিয়ে নিয়ে শেষ আখড়া কলেজ স্ট্রিটের পুঁটিরাম। সেখানে অবশ্য আরেকটু যোগ হলো কচুরির সঙ্গে টকদই, আর রসমালাই। আমাদের সুদীপ্ত দার একটু মিষ্টিমুখ না করলে কেমন খালিখালি লাগে কিনা! 

PutiramSweets, kolkatastreetfood, foodblogger, foodblog, kolkata, bengaliblogger

মন ভালো লাগে, চারপাশ কেমন যেন বদলে যায় সুখাদ্য গ্রহণের পরে। অতএব, এদিকের পাট চুকিয়ে আমরা গেলাম ধর্মতলায়। মশাই, ৪০/- টাকায় সেই লস্যি, উফফ!! খোয়াক্ষীর, কাজু, কিশমিশ, চেরি দিয়ে সুসজ্জিত। এটা এক গ্লাস খেলেই তো পেট ভরে যায়! 

Lassi, kolkatastreetfood, foodblogger, foodblog, kolkata, bengaliblogger

অতঃপর, বিদায় নেওয়ার পালা, কিন্তু আজ প্রাতঃরাশের জন্যে এই ছোট্ট সফর মনে থাকবে, অনেকদিন পরে সকালে ঘোরাঘুরি হলো, আর আমাদের খাদ্যসফরও আরেকটি ভোরেই শুরু হয়েছিল। পরেরবার অবশ্যই অন্যরকম আনন্দময় এক অধ্যায় নিয়ে আসবো এই-ই আশা। আপাতত, পুজো সব্বার ভালো কাটুক। ☺️

Saturday, August 27, 2022

মেট্রো চরিত


মেট্রো রেল কলকাতার অন্যতম গর্ব। ব্যস্ত অফিস্টাইমে যানজটহীন সওয়ারি হিসেবে মেট্রোর বিকল্প বোধহয় খুব কমই আছে। সেই ১৯৮৪তে পথ চলা শুরু করার পর থেকেই "পাতাল রেল" (তৎকালীন) খানিকটা "বোরোলিনের" মতোই (বঙ্গ জীবনের অঙ্গ) কলকাতা জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে পরিসর বেড়েছে মেট্রো রেলের। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের ভিড়। আজকাল অফিস টাইমে খানিকটা লোকাল ট্রেনের মতোই গুঁতোগুঁতি ধাক্কাধাক্কি হওয়াটা জলভাত ব্যাপার হয়ে গেছে মেট্রো যাত্রীদের কাছে। তবে কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যায়... তাই এটুকু সমস্যা মেনে নেওয়াই যায় আরকি!

রোজ কতশত মানুষ মেট্রোতে নিজের গন্তব্যে পাড়ি দেন। একটু লক্ষ্য করলেই এইসব মানুষের মধ্যেই প্রচুর মজার উপাদান পেয়ে যেতে পারেন! চলুন... আজ বরঞ্চ এইরকমই কিছু মানুষকে নিয়ে হালকা মজার আলোচনা করা যাক! 😀

১. দৌড়বিদ - প্রথমেই এঁদের কথা না বললেই নয়! এঁদের সবসময় খুব তাড়া! ধরুন প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকছে... এস্কেলেটরে জম্পেশ ভিড়... সবাই আগত ট্রেনটি ধরবে.... এমন সময় এই দৌড়বিদরা হটাৎ জেগে ওঠেন! পাক্কা প্রফেশনাল ফুটবলারদের মতো সামনের ভিড় খানিক গুঁতিয়ে, খানিক ডজ্ করে এঁরা মেট্রো ধরতে অগ্রসর হন! তবে পাশের সিঁড়ি খালি থাকলেও এঁরা নিজেদের "স্কিল" ভুলেও সিঁড়িতে দেখান না... ওখানে বড্ড খাটুনি যে! 😁 

এছাড়াও বাড়ি ফেরার সময়তেও এঁদের তাড়া দেখবার মতো! মেট্রোর গেট থেকে প্ল্যাটফর্মে পা রেখেই যেভাবে দৌড় শুরু করেন তাতে উসেইন বোল্ট লজ্জায় পড়ে যাবেন! যেন গেট থেকে আগে বের হলেই মেট্রো কর্তৃপক্ষ পুরস্কৃত করবেন! 😆

২. নট সো সিনিয়র সিটিজেন - যাঁরা মেট্রোতে যাতায়াত করেন তাঁরা সবাই সিনিয়র সিটিজেন সিট সম্বন্ধে অবগত। এই বিশেষ সিট খালি থাকলে কম বেশী সবাই বসে যাই এখানে। আবার বয়স্ক কেউ উঠলে বেশিরভাগ লোকজনই সিট ছেড়ে দেন। কিন্তু একটি বিশেষ সম্প্রদায় আছেন যাঁরা সিট ছাড়তে অপরাগ! কোনও বয়স্ক যাত্রী এঁদের সিট ছেড়ে দিতে বললে এমন ভাবে তাকান যেন সিট নয় কিডনি চেয়ে ফেলেছে! 😆 অনেকেই আবার তক্ষুনি প্রচণ্ড ঘুমিয়ে পড়েন! এক দুবার ডাকলেও উঠতে চান না। অবশ্য সহযাত্রীদের হস্তক্ষেপে শেষমেষ সিট ছাড়তে বাধ্য হন।

৩. মরাল পুলিশ - এঁদের আবার সমাজের অবক্ষয় নিয়ে দারুণ চিন্তা! বিশেষত ট্রেনে কোনও প্রেমিক যুগল উঠলেই এঁরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন! তাঁদের সময় কি ছিল আর বর্তমানে সমাজের কি হাল এটাই মূলত এঁদের আলোচনার বিষয়! এমনিতে আলোচনা অবধি ঠিক আছে কিন্তু কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লে গোল বাঁধে তখন! 🙁

৪. ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায় - অফিস টাইমে আজকাল ভিড় ব্যাপারটা জলভাত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে এত ভিড় হয়ে যায় যে ঠিকমতো দাঁড়ানোই দায় হয়ে পড়ে। হালকা ধাক্কাধাক্কি চলতেই থাকে যার বেশিরভাগটাই অনিচ্ছাকৃত। কিন্তু কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা ওই যাকে বলে "ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়"! এঁরা অনেকটা মোবাইলের টাচ স্ক্রিনের মত! অল্প টাচ লাগলো কি দপ করে জ্বলে উঠল! নিজেরাও যে ভিড়ের মধ্যে অন্যকে ধাক্কা দিচ্ছেন সেই ধারণা অবশ্য এঁদের মগজে ঢোকানো দুষ্কর! 😆

৫. বই পোকা - এঁরা একটু ধির স্থির প্রকৃতির। চুপ চাপ মেট্রোয় উঠে একটা অপেক্ষাকৃত খালি জায়গা খুঁজে প্রথমেই দাঁড়িয়ে পড়েন। বসার জায়গা মিললে তো কথাই নেই! একটু পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে ব্যাগ থেকে বই বের করে সোজা তার মধ্যেই ডুবে যান। তারপর দুনিয়া গোল্লায় যাক... বই পড়ায় প্রভাব পরে না! শুধু মাঝে মাঝে মুখ উঠিয়ে দেখে নেন গন্তব্য এসে গেল কিনা। ও হ্যাঁ... আমিও নিজেও কিন্তু এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত! 😆

এছাড়াও আরো কত ধরণের মানুষ দেখতে পাবেন। কেউ খালি সিট দেখেও বসতে চান না। সহযাত্রীরা খালি সিট দেখিয়ে দিলেও সামান্য হেসে অথবা মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দেন তিনি দাঁড়িয়েই খুশি! কেউ আবার আপাতদৃষ্টিতে ভর্তি সিটের মধ্যেও বসার জায়গা খুঁজে নেন! সিটের সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমত "হেড" কাউন্ট করে বসার জায়গা বের করে নেন! কেউ রাজনীতি নিয়ে তর্ক করেন তো কেউ নিত্য দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত থাকেন। এছাড়াও খেলাধুলো, অফিসের চাপ এইসব নিয়ে আলোচনা বাকবিতণ্ডা তো লেগেই থাকে। আসলে... আমরা সবাই... হয়ত নিজেদের অজান্তেই এইসব চরিত্রগুলির অংশ হয়ে যাই। তাই এই লেখাটি কাউকে ছোট করার জন্য নয়। শুধুমাত্র রোজকার ব্যস্ত জীবনযাত্রার মাঝে মজার কিছু মুহূর্ত তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই লেখা। আশাকরি ভাল লাগবে। 😀