"ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন, চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন..."
বিশ্বকবি তাঁর দিগন্তবিস্তৃত দৃষ্টিকোণ থেকে লিখলেও আমার জন্য সেটা এসে ঠেকেছে রসনায়। মানে, এই মুঘলাই, আরবীয়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন খাদ্যাভ্যাস এবং প্রচলিত, খ্যাত, আবার একান্ত নিজস্ব যে পদের বিভিন্নতা, আগ্রহ তো জাগেই, তাই না?
কিছুকাল আগে শুনলাম আমাদের শহরে রেস্তোরাঁ হয়েছে যেখানে একেবারে মরু দেশের কায়দায়, সজ্জিত সান্নিধ্যে আপ্যায়ন করা হচ্ছে! বেশ ভালো, তখনই স্থির করে ফেলা গেলো একবার সচক্ষে দর্শন, এবং আহারাদি সম্পন্ন করে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করে আসতে হবে। তাই, আমার বন্ধুবান্ধব, খাদ্যরসিক, যারা পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষেত্রে পিছপা নয়, সবাই মিলে হাজির হলাম পার্ক সার্কাসের "বার্কাস" রেস্তোরাঁয়।
আমরা যখন উপস্থিত হলাম, একে একে দুয়ে দুয়ে, রেস্তোরাঁ প্রায় পূর্ণ, কারণ সহজ, আজ রবিবাসরীয় তিথিতে কে-ই বা ঘরের কোণে থাকতে চায়? রেস্তোরাঁ সুসজ্জিত, সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো "দরবার", সুন্দর মখমলি গদী বিছানো, ও তাকিয়া রাখা, কাষ্ঠনির্মিত মেজ, যেখানে খাদ্যপানীয় বাসনাদি রেখে খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। আমরা ঠিক করেছিলাম, বলা ভালো প্রধান কারণ এখানে আসার, "লাহাম মান্ডি", যা কিনা বিরিয়ানির একটি আরবীয় সংস্করণ, সেটা চেখে দেখতে হবে। এছাড়া, শেষ পাতে আসবে "কুনাফা", বা "Knafeh"।
প্রথমেই আমরা সুন্দর এই পরিবেশের আনন্দ অনুভব করলাম, ও তারপর বললাম সূচক হিসেবে "চিকেন শূরবাঁ", যা অবশ্যই আরবীয় স্যুপ, আর "শিস তাউক", বা "চিকেন শীস কেবাব" আনা যাক। মৃদু স্বাদের স্যুপ, ও নরম আঁচে সুপক্ব মাংসের কেবাব সত্যিই সুন্দর; সহজপাচ্য ও সুস্বাদু। ততক্ষণে অন্যান্য "দরবারে" মান্ডির আনাগোনা দেখে আমাদেরও কৌতূহল রসনা ও মস্তিষ্ক দুই-ই সচল করে তুলেছে! আমরা সবাই-ই যাকে বলে উদরপূর্তি শুধু নয়, মানসিক তৃপ্তিতে বিশ্বাসী, তা-ই যখন বিরাটকার কাংস্যনির্মিত থালায় সুসজ্জিত লাহাম মান্ডি এলো, সে এক দারুণ আনন্দের, মন ভালো করার মুহুর্ত!
শীস তাউক |
চিকেন সূর্বা |
চারপাশে রন্ধিত মশলাদি দেওয়া চাল, অর্থাৎ এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, স্টার আনিস ইত্যাদি দিয়ে, এবং মধ্যমণি হয়ে বিরাজমান মাংস খণ্ড, এমন নরম তুলতুলে সুসিদ্ধ মাংস আমি কখনো খাইনি, যা এই পরিমাপের! মান্ডি রান্না করা হয় পিট কুকিং পদ্ধতিতে, যা বিভিন্ন দেশে, ও স্থান অনুযায়ী কিছুটা বদলায়, বদলায় উপকরণও। এখানে কিভাবে করা হয়েছে তা জানিনা, কিন্তু রান্নার প্রণালী ও প্রকার অতিক্রম করে মন ছুঁয়ে গেছে অবশ্যই, কারণ সাধারণত বিরিয়ানি খেয়ে যে ভারী অনুভূতি, সেটি এক্ষেত্রে হয়না।
লাহাম মান্ডি বিরিয়ানি |
এছাড়া, বন্ধুবান্ধবদের, প্রিয়জনের সঙ্গে একই থালায় ভাগ করে খাওয়ার মজা, আনন্দ, সে তো ভালো লাগারই কথা, সুযোগ হয়না, পরিস্থিতিও নেই, মনে পড়ে যাচ্ছিলো ছাত্রাবস্থায় হোস্টেলে খাওয়াদাওয়ার সময় হৈ-হুল্লোড়।
যা-ই হোক, এটি খেয়ে মোটামুটি যা মনে হলো, চারজন নয়, এটা খাইয়েরা দুজনেই খেয়ে নিতে পারেন, বা তিনজন। তারপর, শেষ পাতে আরেকবার ঠাণ্ডা পানীয়, ও সেই ডেসার্ট পদ, বা মিষ্টি, কুনাফা। এই পদটিও মধ্যপ্রাচ্যের, কিছুটা গ্রীক বাকলাভার সঙ্গে মিল আছে, এবং এর অনেক সংস্করণ, রূপ আরব দুনিয়া থেকে দক্ষিণপূর্ব ইউরোপেও খ্যাত, অর্থাৎ বালকান উপদ্বীপীয় অঞ্চলে। আমি মিষ্টি খুব একটা ভালোবাসি না, তবে ক্ষীরের মতো উপকরণ, উপরে ভাজা সেমাই ও শুকনো ফল, মোটের উপর মন্দ নয়। তবে, আজকের নায়ক লাহাম মান্ডি বেশ ভালো লাগলো, কারণ আগেই বলেছি, সুস্বাদু, ও সহজপাচ্য।
কুনাফা |
যা-ই হোক, খেয়েদেয়ে তো চুপচাপ বাড়ি ফেরার মানুষ আমার সঙ্গীরা নয়। আজকের সফরে প্রথমবার এসেছিলো চিরঞ্জয়ের স্ত্রী রিম্পা, ছোট্ট রিয়ান, ও আমাদের রায় বাবুর বন্ধু পিয়াল। পিয়ালের সঙ্গে আমাদের প্রথম আলাপ, অত্যন্ত সপ্রতিভ, মিষ্টভাষী, ও আলাপী, তার কাছে ঢাকার কাচ্চি নিয়েও কিছু আলাপচারিতা হলো। তারপর, চিরঞ্জয়রা আজকের মতো বিদায় নিলো, আমরা ছুটলাম একপাক প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে, গঙ্গার হাওয়ায় হজম ভালো হয় কিনা! সেখানে আরেকপ্রস্থ আড্ডা, গল্প, ও ছবির পালা।
প্রতিটি দিনেরই শুরু ও শেষ হয় আরেকটি দিনের জন্য অপেক্ষায়, প্রত্যাশা ও পদক্ষেপের সন্ধিক্ষণে। আমাদের আজকের সফর ছিলো তেমনই একটি দিন, আগেরবারগুলোতে যারা ছিলো, তাদের বারবার মনে করে দুঃখ করছিলাম, আবার নতুনদের আসায় প্রাপ্তিও হলো। আগামীর জন্য আবার কিছু থাকবে, এই আশা নিয়ে আজকের মতো বিদায় নিলাম।
রেস্তোরাঁর এই বিশেষ পদটি জানা গেলো হায়দরাবাদের একটি গ্রামের থেকেই সংগ্রহীত নিজস্ব মশলা ইত্যাদি থেকে তৈরি, তা সে যা-ই হোক, মন ভালো করে দিয়েছে সুন্দর সঙ্গ, আর সুন্দর যা, তা-ই তো সত্য। আমার আবার, সবার উপরে মন ভালো করাটাই সত্য, তার উপরে? নাই। 😊
No comments:
Post a Comment