নবাবদের নগরী লখনউ। শহরটার সঙ্গে আমার পরিচয় কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই। ফেলু মিত্তিরের অ্যাডভেঞ্চার "বাদশাহী আংটি" মনে পড়ে? আরে সেই যে ধুরন্ধর বনবিহারি বাবুর হাত থেকে বাদশাহী আংটি উদ্ধারের গল্প... তার সূত্রপাত তো এখানেই! স্কুলের ইতিহাস বইয়ে লখনউ এর কথা পড়েছিলাম বটে তবে ওই বাদশাহী আংটির লখনউ বর্ণনাই মনে দাগ কেটে গেছিল। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল একবার হলেও যাবো.... তাই বেনারস পর্ব শেষ করেই নবাব নগরীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। আজ সেই নবাবদের শহরের গল্পই শোনাই তবে।
ঐতিহাসিক এই নগরীর বর্তমান পরিচিতি উত্তরপ্রদেশের রাজধানী হিসেবে। নবাবদের রাজ্যপাট কবেই চুকে গেছে তবু সেই আমলের সংস্কৃতি আর তেহ্জিব এখনও শহরটার শিরায় শিরায় মিশে আছে। জনশ্রুতি বলে সেই রামায়ণের যুগে লক্ষ্মণ এই শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তাঁর নামেই শহরের নামকরণ হয়েছিল "লক্ষণাপুরি" (মতান্তরে লক্ষণাবতি)। সময়ের সাথে সাথে সেই নাম ক্রমে "লছ্মনপুর" হয়ে আজকের "লখনউ"! নিজের দীর্ঘ জীবনকালে এই শহর অনেক রাজা বাদশার শাসন দেখেছে... সে গজনীর মাহমুদ হোক বা মুঘল সম্রাট হুমায়ূন। তবে আজকের যে লখনউ কে আমরা চিনি তার সূত্রপাত হয় ১৭৩২ সালে, প্রথম নবাব সাদাত খানের হাত ধরে। তারপর, প্রায় ১৫০ বছর পর, অর্থাৎ ১৮৫৭র সিপাই বিদ্রোহের সময়, শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কে ইংরেজরা "গৃহবন্দি" করে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে পাঠানোর সঙ্গেই সঙ্গেই নবাবি সাম্রাজ্যের ইতি হয়। সে হোক গে... ইতিহাস তার জায়গায় থাক... ওই নিয়ে অত কচকচির দরকার নেই। তার চেয়ে বরং ঘোরার গল্পটাই শোনাই। তবে ঐতিহাসিক জায়গা তো... মাঝে মাঝে ইতিহাস ঢুকেই পড়বে বৈকি!
ট্রেন থেকে চারবাগ স্টেশনে নেমে রওনা দিলাম গন্তব্য স্থলে। মানে আলিগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত আমাদের অফিসের হলিডে হোমে। পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেছিল তাই সেদিন আর ঘোরা হয়নি। তবে কাছেই "তুন্দে কেবাবির" একটা ব্রাঞ্চ ছিল। বুঝতেই পারছেন বেশ জমিয়ে পেট পুজো হয়েছিল! পরদিন সকালে আমাদের লখনউ ব্রাঞ্চ অফিসের ম্যানেজারের কাছ থেকে শহরের দর্শনীয় স্থানগুলোর ব্যাপারে জেনে নিয়ে সেইমত বেড়ানোর প্ল্যান করে নিলাম। প্ল্যান অনুযায়ী যেভাবে ঘুরেছিলাম সেভাবেই বর্ণনা করি।
১. রুমি দরওয়াজা - হলিডে হোম থেকে বেড়িয়ে অটো ধরে পৌঁছে গেলাম লখনউ শহরের "আইকন" রুমি দরওয়াজার সামনে। অটো থেকে নেমে একটা ঘোড়ার গাড়িতে উঠে পড়লাম। নবাবি আমলের স্থাপত্য ঘোড়া গাড়ি চেপে দেখতে বেশ নস্টালজিক লাগছিল। তাছাড়া টাঙ্গাওয়ালা চাচা গাইডের কাজটাও বেশ করছিলেন। একদিকে টগ্ বগ্ শব্দে ঘোড়া চলেছে অন্যদিকে চাচার গল্প চলছে... ব্যাপারটা যাকে বলে জমে ক্ষীর একদম!
রুমি দরওয়াজা |
রুমি দরওয়াজা নির্মিত হয় ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে, নবাব আসফ উদ্ দৌলার আমলে। ৬০ ফুট উঁচু এই দরজাটি শহর কনস্ট্যানটিনপেলের একটি দরজার অনুকরণে তৈরী হয়েছিল। নবাবি আমলে পুরানো লখনউ শহরের প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হতো এই দরজাটি।
২. বড়া ইমামবাড়া - রুমি দরওয়াজাকে পিছনে ফেলে আমাদের টাঙ্গা এগিয়ে চলল বড়া ইমামবাড়ার দিকে। আসফ উদ্ দৌলার আমলেই ১৭৮৫ থেকে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয় বিশাল এই স্থাপত্য। গেটে টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ইমামবাড়ার বিশালত্ব দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়! ভিতরে গাইড নিয়েছিলাম। আসলে এসব ঐতিহাসিক জায়গায় গাইড না নিলে অনেক গল্পই অজানা থেকে যায়। ইমামবাড়া ছাড়াও এখানে আছে আসফি মসজিদ, বাওলি বা স্টেপ ওয়েল এবং বিখ্যাত ভুল ভুলাইয়া। এছাড়াও এখানে নবাব আসফ উদ্ দৌলা এবং তাঁর স্ত্রী সামসুন্নিসা বেগমের সমাধী আছে। ইমামবাড়ার সুবিশাল সেন্ট্রাল হলটির (আমার মনে হয়েছিল আস্ত একটা ফুটবল মাঠ ধরে যাবে ওর ভেতরে!) বিশেষত্ব হল এখানে কোনওরকম খিলান বা পিলার দেখতে পাবেন না! ভাবুন তো অতবড় একটা স্থাপত্য অথচ একটাও পিলার নেই!
বড়া ইমামবাড়া |
গাইড সাহেবের কাছে ইমামবাড়ার বিভিন্ন গল্প শুনতে শুনতে আর বাওলি দেখার পর আমরা পৌঁছে গেলাম বড়া ইমামবাড়ার আসল আকর্ষণ ভুল ভুলাইয়া তে! সে এক গোলকধাঁধা বটে! জনশ্রুতি বলে নবাবরা নাকি এখানে বেগমদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন। নবাবি খেয়াল তো... কতকিছুই না করতেন তাঁরা! তবে সঙ্গে গাইড না থাকলে এখানে রাস্তা গুলিয়ে ফেলাটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর আমরা তো কেউ প্রদোষ মিত্তির নয় যে মগজাস্ত্র খাটিয়ে বেড়িয়ে আসব... তাই গাইড সাহেবের সাহায্য নিয়ে বেরিয়ে এলাম!
ভুল ভুলাইয়ার গোলকধাঁধায় |
৩. ছোটা ইমামবাড়া - বড়া ইমামবাড়া দেখে এগোলাম পরবর্তি গন্তব্য ছোটা ইমামবাড়ার দিকে। বড়া ইমামবাড়ার কাছেই অবস্থিত এই জায়গাটি। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে নবাব মহম্মদ আলি শাহের শাসনকালে নির্মিত হয় এই স্থাপত্য। ইমামবাড়ার মধ্যে দেখতে পাবেন মহম্মদ আলি শাহের তাজ বা মুকুট, তাঁর এবং তাঁর পরিবারবর্গের সমাধী, বেলজিয়ান কাঁচের ঝাড়বাতি ইত্যাদি। এছাড়াও ঘুরে দেখতে পারবেন নহবত খানা, ট্রেজারি বিল্ডিং ইত্যাদি।
ছোটা ইমামবাড়া |
৩. হুসেইনাবাদ ক্লক টাওয়ার এবং আর্ট গ্যালারি - ছোটা ইমামবাড়া পর্ব সেরে চলে এলাম পরবর্তি দ্রষ্টব্য হুসেইনাবাদ ক্লক টাওয়ার দেখতে। এখানে আমাদের টাঙ্গাওয়ালাকে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলাম ক্লক টাওয়ারের দিকে। লন্ডনের বিগ বেনের অনুকরণে তৈরী এই ক্লক টাওয়ারের নির্মাণকাল ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ। প্রায় ২২০ ফুট উঁচু এই ক্লক টাওয়ার লখনউ শহরের অন্যতম আকর্ষণ। এখানে এলে অবশ্যই পাশের আর্ট গ্যালারিতে ঘুরে আসবেন। নবাবি আমলের অসাধারণ সব ছবির সংগ্রহশালা এই আর্ট গ্যালারি ঘুরে দেখতে ভালই লাগবে। গ্যালারি গেলে অবশ্যই গাইড নেবেন, নাহলে প্রতিটি ছবির বিশেষত্ব বুঝতে পারবেন না।
ক্লক টাওয়ার |
৪. রেসিডেন্সি - আর্ট গ্যালারি দেখে নিয়ে অটো ধরে চললাম পরবর্তী গন্তব্য কাইজারবাগ এলাকায় অবস্থিত রেসিডেন্সি। সিপাহি বিদ্রোহের অন্যতম সাক্ষী এই জায়গাটি। ১৮৫৭ সালে যখন বিদ্রোহের সময় বেগম হজরত মহলের নেতৃত্বে সেনাধ্যক্ষ বরকত আহমেদ বিদ্রোহী সেনাদের একজোট করে রেসিডেন্সি দখল অভিযান শুরু করলেন। রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধ চলেছিল ১৮৫৭ সালের ৩০শে জুন থেকে ২৭শে নভেম্বর অব্দি। বহুদিন ধরে চলা এই যুদ্ধে শহীদ হন অগুনতি ভারতীয় সেপাই (সঠিক হিসেব আজ অব্দি পাওয়া যায়নি)। ইংরেজদের পক্ষ্যেও হতাহতের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। তৎকালীন রেসিডেন্ট জেনারেল স্যার হেনরি লরেন্স, মেজর জেনারেল জন ইংলিশ সহ অনেক ইংরেজ কর্তাব্যক্তিরা নিহত হন এই যুদ্ধে। কোম্পানির সৈনিক, সিভিলিয়ান এবং আধিকারিক সহ নিহতের সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৫০০ তে। অবশেষে জেমস আউট্রামের (যার নামে কলকাতার আউট্রাম ঘাট) নেতৃত্বে রেসিডেন্সি দখল মুক্ত করা হয় ২৭ নভেম্বর ১৮৫৭ তে। সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের চিন্হ আজও দেখতে পাবেন রেসিডেন্সির ভিতরে অবস্থিত বিল্ডিংগুলোর গায়ে। প্রায় ৩৩ একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছিল রেসিডেন্সি। নির্মাণকাল ১৭৭৫ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ। ভিতরে ঘুরে দেখে নিতে পারবেন বেইলি গেট, ট্রেজারী বিল্ডিং, ব্যাঙ্কয়েট হল, ডঃ ফায়রেরের বাড়ি, মূল রেসিডেন্সি বিল্ডিং, ১৮৫৭ মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, বেগম কুঠি, ব্রিগেড মেস, ইমামবাড়া সহ বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত ইমারতগুলো।
বেইলি গেট |
দেওয়ালে যুদ্ধের চিন্হ |
রেসিডেন্সির ধ্বংসাবশেষ |
রেসিডেন্সি লেখা নামফলক |
রেসিডেন্সি দেখা যখন শেষ হল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। পেটে তখন ছুঁচোয় ডন মারছে একেবারে। তাই আর এদিক ওদিক না করে চললাম সোজা আমিনাবাদ। উদ্দেশ্য পেটপূজো এবং অবশ্যই মার্কেটিং। আমিনাবাদ ছিল সেবারের লখনউ সফরের শেষ গন্তব্য। আর লখনউ এর খাওয়া দাওয়া নিয়ে লিখতে গেলে আলাদা একটা ব্লগ পোস্ট লিখতে হবে! ওখানকার গলৌটি কেবাব, পায়া নীহারি, মালাই কেবাব, শিরমল, লাচ্ছা পরোটা, আমিনাবাদ চত্বরের প্রকাশের কুলফি এবং অবশ্যই আওয়াধি ঘরানার বিরিয়ানি না খেলে নিজেকে মাফ করা সম্ভব হত না কোনোদিন! আর সেসব সুখাদ্যের ব্যাখ্যা কি আর এক দু লাইনে করা সম্ভব? তাই সে গল্প নাহয় আরেকদিন হবে।
ঐতিহাসিক শহর লখনউ আমার বেশ কিন্তু লেগেছিল। নবাবদের স্মৃতি বিজড়িত দ্রষ্টব্য স্থান এবং আওয়াধি ঘরানার খাওয়া দাওয়া নিয়ে খাসা জায়গা। ইদানিং কলকাতায় আওয়াধি ঘরানার অনেক রেস্টুরেন্ট হয়েছে। তবে হলফ করে বলতে পারি লখনউ এর সেই স্বাদের ধরে কাছে যায় না তারা। বলতে পারেন শুধুমাত্র সেই স্বাদ পেতেই আবারও ঘুরে আসা যায় নবাবদের নগরী লখনউতে!
Awesome!!!
ReplyDeleteDarun darun... Jio
ReplyDeleteVery nice..
ReplyDeleteকি অসাধারণ লেখাটা! আমি অভিভূত। যেন চোখের সামনে সব ফুটে উঠছিল।
ReplyDeleteআমার এখনও যাওয়া হয়নি, কবে যে যাবো!
dhasu 👍👍
ReplyDeleteআহা, আহা!!!
ReplyDelete